সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে জুলাই আন্দোলনের শহীদ দাবি করে মামলা

রাজশাহী মহানগরীর গোলজারবাগ এলাকার মিনারুল ইসলাম (২৯) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। মিনারুল ছাত্র আন্দোলনে ‘গুলিবিদ্ধ’ হয়ে মারা গেছেন এমন দাবি করে তাঁর ভাই থানায় হত্যা মামলা দায়ের করলেও, সিটি করপোরেশনের জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভার বলছে, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন গত ২০ জুলাই। এলাকাবাসীর ভাষ্য, মিনারুল নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, তাঁর লাশ এলাকায় আনা থেকে দাফন পর্যন্ত সবাই এমনটাই জানত। মিনারুল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, এমনটা তাঁরা জেনেছেন থানায় মামলা হওয়ার পর।
Read More News

মামলার আসামিদের দাবি, মিনারুলের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হলেও পূর্বশত্রুতার কারণে তাঁর মৃত্যুকে জুলাই ছাত্র আন্দোলনের ‘মৃত্যু’ সাজিয়ে ফায়দা নিতে হত্যা মামলা করেছেন তাঁর ভাই নাজমুল হক। মিনারুল ইসলাম রাজশাহী নগরীর গোলজারবাগ এলাকার মৃত এনামুল হকের ছেলে। মামলার বাদী নাজমুল হক মিনারুলের আপন বড় ভাই। মিনারুল নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি গার্মেন্টসে চাকরির করার কারণে সেখানেই বসবাস করতেন। মাঝেমধ্যে রাজশাহীতে আসতেন। চলতি বছর ২০ জুলাই গার্মেন্টসের কাজ শেষ করে ফেরার পথে সন্ধ্যা ৬টায় আল আমিন নগর পাওয়ার হাউজ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। স্থানীয়রা উদ্ধার করে খানপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন রাতেই তাঁর লাশ রাজশাহীতে আনা হয় এবং পরদিন ২১ জুলাই মহানগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২১ জুলাই মিনারুলের লাশ দাফনের পর তাঁর আরেক ভাই রাকিবুল ইসলাম গোরস্থানের রসিদ বা ছাড়পত্র সংগ্রহ করেন। সেখানে রাকিবুল ইসলাম এই মৃত্যুকে মৌখিকভাবে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের স্বাক্ষরিত রসিদ সংগ্রহ করেন। রসিদে দেখা গেছে, মিনারুলের ভাই রাকিবুল ইসলাম তথ্য প্রদানকারী এবং তাঁর আরেক ভাই মো. সোহেল তথ্য শনাক্তকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন। রসিদের কোথাও হত্যা মামলার বাদী নাজমুল হকের স্বাক্ষর বা উপস্থিতি নেই। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মিনারুল ইসলামের দাফন ও গোরস্থানের রসিদ সংগ্রহের প্রায় এক মাস পরে গত ২৪ আগস্ট পরিবারের পক্ষ থেকে ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে ‘মৃত্যুনিবন্ধন সনদ’ পেতে অবেদন জানানো হয়। মৃত্যুনিবন্ধন সনদসংক্রান্ত অনলাইন সার্ভারে আবেদন রেজিস্ট্রেশন করে ইস্যু করে কার্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর ২৭ আগস্ট মিনারুলের পরিবারের কাছে কাউন্সিলর ও সচিব স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত মৃত্যুনিবন্ধন সনদ প্রদান করা হয়। সনদটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সনদে মিনারুলের পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর কারণ ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় দেড় মাস পর ৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় গিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন নাজমুল হক। এজাহার সূত্রে জানা গেছে, দায়ের করা মামলায় মিনারুলের মৃত্যুর কারণ আর সড়ক দুর্ঘটনা নেই। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে জুলাই ছাত্র আন্দোলনে মিনারুলকে গুলি করা হয়েছে এবং সেই গুলিতে মিনারুল কিডনির নিচে আঘাপ্রাপ্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কারণ বর্ণিত করা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কোনো রেফারেন্স উল্লেখ করা নেই। এমনকি মনিরুলের লাশের কোনো ময়নাতদন্তও করা হয়নি। হত্যা মামলার এজাহারে ১৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৪০০ জনকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঘটনা নারায়ণগঞ্জের হলেও মামলার এজাহারভুক্ত ১৩২ আসামির মধ্যে ৪৮ জনই মিনারুলের রাজশাহীর প্রতিবেশী। নাজমুল হক জানান, তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তবে রাজশাহীর মানুষ কীভাবে আসামি হলো, সেটি তিনি জানেন না। যাঁরা তাঁকে মামলা করতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি তাঁর। নিহত ব্যক্তির মা ডলি বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতা ছিল না। নারায়ণগঞ্জের আসামির সঙ্গে রাজশাহীর লোকজনের নাম কে দিল জানি না।’ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানান, মামলাটির তদন্ত চলছে। বাদী যদি মিথ্যা মামলা করে থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *