বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল আগামীকাল শনিবার। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সকাল ১০টায় কাউন্সিলের উদ্বোধন করবেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অনুষ্ঠানে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন তিনি। তার বক্তব্যে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দল সুসংগঠিত করার প্রসঙ্গ যেমনি থাকছে, তেমনি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী দিনে দলীয় অবস্থানও তুলে ধরবেন তিনি।
কাউন্সিল আয়োজনের প্রায় সব প্রস্তুতিই শেষপর্যায়ে। কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটি ও ১১টি উপকমিটি তাদের দায়িত্ব শেষ করে এনেছে। কাউন্সিলর কার্ড ও ডেলিগেট কার্ড বিতরণ চলছে। প্রায় তিন হাজার কাউন্সিলর থাকছেন অনুষ্ঠানে। কাউন্সিলর, ডেলিগেট, আমন্ত্রিত অতিথি ও উৎসুক নেতাকর্মী মিলিয়ে উপস্থিতির সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে দলটির নেতারা ধারণা করছেন।
গতকাল কাউন্সিল ভেনুতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরোদমে চলছে মঞ্চ ও আগতদের বসার স্থান তৈরির কাজ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ভেতরের চত্বরে কেবল কাউন্সিলর ও আমন্ত্রিত অতিথিদের বসার জায়গা করা হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে বসবেন ডেলিগেটরা। গতকাল দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কাউন্সিল ব্যবস্থা উপকমিটির আহ্বায়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
সকাল ১০টায় শুরু হয়ে কউন্সিলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হবে মধ্যাহ্নভোজের মধ্য দিয়ে। এরপর বেলা ৩টা থেকে শুরু হবে রুদ্ধদ্বার অধিবেশন। এতে আলোচ্যসূচিতে রয়েছেÑ শোক প্রস্তাব উপস্থাপন, দলের চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির রিপোর্ট পেশ, মহাসচিবের সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা, দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সংশোধন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছাড়াও লন্ডন থেকে ভিডিও বক্তব্য দেবেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
কাউন্সিল উপলক্ষে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ভিড় জমেছে নেতাকর্মীদের। কার্যালয়ের তৃতীয় তলা থেকে বিতরণ করা হচ্ছে কাউন্সিলর কার্ড। কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বরাদ্দের চেয়ে বেশি ডেলিগেট কার্ড সংগ্রহের জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলাপর্যায়ের নেতারা এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা হন্যে হয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। কার্ড বিতরণের দায়িত্বে থাকা নেতাদের কাছে তারা তদবির করছেন নানাভাবে। নেতাকর্মীদের এমন ভিড় দেখে সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুন বেগম বলেন, ‘এ দেখছি ঈদ’।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের দৃশ্যও পাল্টে গেছে। পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে কার্যালয়ের আশপাশ। কারাবন্দী ও সিনিয়র নেতারা ছবি দিয়ে কাউন্সিলকে স্বাগত জানিয়ে বিশাল ব্যানার টানিয়েছেন। পাঁচতলাবিশিষ্ট কার্যালয় ঢেকে দেয়া হয়েছে কাউন্সিলের বিশাল ব্যানারে। এতে লেখা রয়েছে এবারের কাউন্সিলের মূল প্রতিপাদ্যÑ ‘মুক্ত করবোই গণতন্ত্র’। ব্যানারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছোট প্রতিকৃতিও স্থান পেয়েছে।
বিএনপির কাউন্সিলের এবারের মূল স্লোগানÑ ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’। কাউন্সিল উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তৈরি করা হয়েছে লোগো, ওয়েবসাইট ও থিম সং। বিএনপির ১১টি সহযোগী সংগঠনও ভিন্ন ভিন্ন স্লোগানে পোস্টার তৈরি করেছে। যুবদলÑ ‘তারুণ্যে যারা অকুতোভয়, তারাই আনবে সূর্যোদয়’, কৃষক দলÑ ‘ফলাবো ফসল, গড়বো দেশ, গণতন্ত্রে বাংলাদেশ’, মুক্তিযোদ্ধা দলÑ ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র, মুক্ত করো গণতন্ত্র’, শ্রমিক দলÑ ‘শ্রম দিয়ে শিল্প গড়বো, দেশের আঁধার ঘুচিয়ে দেবো’, মহিলা দলÑ ‘চেতনায় নারী, বিপ্লবে নারী, গণতন্ত্র ফেরাতে আমরাই পারি’, ছাত্রদলÑ ‘বাঁচতে চাই, পড়তে চাই, দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই’, স্বেচ্ছাসেবক দলÑ ‘আলোর দিন দূরে নয়, করতে হবে আঁধার জয়’, জাসাসÑ ‘গাইবো মোরা গণতন্ত্রের গান, দুঃশাসনের হবেই অবসান,’ তাঁতী দলÑ ‘শক্ত হতে বাঁধো তাঁত, কাটাতে হবে আঁধার রাত’, মৎস্যজীবী দলÑ ‘জালের টানে ঘুচবে আঁধার, বাংলাদেশ সবার’ এবং উলামা দলÑ ‘জিয়ার আদর্শে দেশ গড়বো, ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখবো’।
তৃণমূলে নতুন উদ্দীপনা : ষষ্ঠ এই কাউন্সিল ঘিরে দলের সকল স্তরে নতুন করে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশেষ করে নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছেন সবাই। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও দক্ষ নেতাদের জায়গা হবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে, এমন আশায় বুক বেঁধেছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতারাও বলছেন, কাউন্সিলের পরে মাসখানেকের মধ্যে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যে কমিটি ঘোষণা করবেন, তাতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় থাকবে। দীর্ঘ ছয় বছর পর কাউন্সিল হওয়ায় কমিটির কলেবরও বাড়বে। গঠনতন্ত্র সংশোধনে নানা প্রস্তাব এসেছে। গত রাতে এসব নিয়ে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক করেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
কাউন্সিল সফলে সরকারের সহযোগিতা কামনা, ভেনু পরির্দশন : কাউন্সিল সফল করতে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কাজ সরেজমিন দেখার পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
ফখরুল বলেন, কাউন্সিল উপলে সারা দেশে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ব্যাপক আলোড়ন জেগেছে। পুনরায় জেগে ওঠার জন্য এই কাউন্সিল যে একটা অনন্য ভূমিকা রাখবে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। আমাদেরকে যে জায়গাটা দেয়া হয়েছে, এখানে সঙ্কুলান খুব কম। আমরা আশা করছি, সরকারের সম্পূর্ণ সহযোগিতা এই কাউন্সিল অনুষ্ঠানের জন্য পাবো।
কাউন্সিল নিয়ে কোনো স্যাবোটাজের আশঙ্কা করছেন কি না প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, এ ধরনের কোনো আশঙ্কা আমরা করছি না। আমরা আশা করি, আমাদের নেতা-কর্মী যারা আছেন, তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে এই কাউন্সিল সফল করার চেষ্টা করবেন।
দুপুর ১২টার দিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আ স ম হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক, শফিক রেহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা মিজানুর রহমান সিনহা, আবদুস সালাম, গিয়াস কাদের চৌধুরী, আফরোজা আব্বাস, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবদুল মজিদ প্রমুখ নেতারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের ভেতরে কাউন্সিলের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেন।
এরপর তারা ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে উদ্বোধন অনুষ্ঠানস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তারা ঘুরে ঘুরে প্যান্ডেল তৈরির কাজকর্ম দেখেন। এ সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, খায়রুল কবীর খোকন, নাজিমউদ্দিন আলম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সানাউল্লাহ মিয়া, আবদুস সালাম আজাদ, শামীমুর রহমান শামীম, রফিক শিকদার প্রমুখ নেতারাও ছিলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এই কাউন্সিল নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে যে অবস্থা সেই অবস্থার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবার জন্য, আমাদের অধিকারগুলোকে ফিরিয়ে আনবার জন্য এই কাউন্সিল একটি অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, আমি আগেই বলেছি, এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপির আবার জেগে উঠবে। দেশের গণতান্ত্রিক যে রাজনীতি তাতে বিএনপি আগে যে ভূমিকা রেখেছে, সেই ভূমিকা রাখতে সম হবে।
এর আগে সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আপ্যায়ন উপকমিটির সংবাদ সম্মেলনে কমিটির আহবায়ক আবদুস সালাম জানান, কাউন্সিলের আমন্ত্রিত কাউন্সিলর, ডেলিগেট ও নেতা-কর্মীদের জন্য দুপুরে পুরনো ঢাকার বিখ্যাত ‘মোরগ পোলাও’ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর চার জায়গায় এই খাবার রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে খাবার বিতরণের জন্য জেলাভিত্তিক নেতাদের নিয়ে ১৯টি কমিটি করে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে।
আবদুস সালাম বলেন, কাউন্সিলের দিন উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মূল প্যান্ডেলে কাউন্সিলর, আমন্ত্রিত দেশ-বিদেশের অতিথিরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। ডেলিগেটসহ সবাইকে বাইরে আসন নিতে হবে। এই সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতা আসাদুল হাবিব দুলু, ফজলুল হক মিলন, হারুনুর রশীদ, হাবিবুর রহমান হাবিব, হাবিবুল ইসলাম, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, মহানগর নেতা কাজী আবুল বাশার, মো: সাহাবুদ্দিন, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, নজরুল ইসলাম কিরন, মনিরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
২০০৯ সালে ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে।