অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যেসব এলাকায় বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই ও আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছে, সেসব এলাকায় ব্যাপক আকারে সহিংসতা ঘটতে পারে। এ জন্য আগে থেকেই এসব এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার শেরে বাংলা নগর এনইসি সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
Read More News
বৈঠকে সহিংসতার দায়ভার পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকীবউদ্দীন আহমদ।
তিনি বলেছেন, সহিংসতার দায় দায়িত্ব পুলিশের ওসিদের নিতে হবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্র দখল করতে দেয়া যাবে না। গুলি থাকা অবস্থায় যাতে কোনো কেন্দ্র দখল করতে না পারে কেউ। সর্বশেষ বুলেটটি ব্যবহার করে হলেও কেন্দ্র বাঁচাতে হবে।
সভায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্য যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ইউপি নির্বাচনে অপ্রীতিকর অবস্থা বেশি ঘটতে পারে। পরিস্থিতি সরকারের ওপর চাপাতে ২০ দল তৎপর থাকবে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিমত। বৈঠকে রিটানিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা গ্রেফতারে পুলিশকে প্রভাবিত করছে বলেও অভিযোগ করা হয়। পুরো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা বড় ধরনের চাপ মন্তব্য করে নির্বাচনকে পুনর্বিন্যস্ত করার দাবি তোলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
বৈঠকের শুরুতে গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছে। সেই এলাকাগুলোতে তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি বেধে যেতে পারে। এটা নির্বাচনে আরেকটি মাত্র তৈরি হবে। এটা যেন না করতে পারে, সে দিকে সজাগ থাকতে হবে। এ ছাড়া গ্রেফতার অভিযান আরো জোরদার করতে হবে।
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন অন্য আরেকটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা। ওই সংস্থার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা তার বক্তব্যে বলেন, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী নেই। যেগুলোতে আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী আছে। ওই সব এলাকায় আওয়ামী লীগের নিজেরা নিজেরা সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, এ নির্বাচন দলীয় পর্যায়ে হওয়ার কারণে পাড়ায় পাড়ায় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দলীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় এ নির্বাচনে অপ্রীতিকর ঘটনা বেশি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হতে পারে। এ জন্য তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার। ২০ দলীয় জোট পরিস্থিতি সরকারের ওপর চাপাতে পারে। প্রভাবশালী নেতাদের এলাকায় একই দল থেকে একাধিক প্রার্থী থাকা গ্রুপিং তৈরি হতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা আরো বলেন, মিডিয়া অপপ্রচার করলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, সে ব্যপারে নির্বাচন কমিশনের ভাবা উচিত। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা সমস্যা আছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রভাব বিস্তার করে সঙ্ঘাতময় পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাই পুরো পার্বত্য অঞ্চলের সব ইউপিতে একই দিনে নির্বাচন হওয়া উচিত। না হলে সন্ত্রাসীরা এক এলাকার নির্বাচন শেষ করে অন্য এলাকায় গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আরো বাড়ানোর পক্ষে মত দেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। যদিও পুলিশ বলছে, পুরো নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নেই। তাই নির্বাচনকে পুনর্বিন্যস্ত করার দাবি তোলেন তারা।
বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, আমার ছয় জেলায় ৩৫০টি ইউপিতে এক দিনে নির্বাচন। ওই পরিমাণ পুলিশ সদস্য আমার রেঞ্জে নেই। আর ভোটের দিন কি অন্য কোনো অপরাধ ঘটবে না? যদি সব পুলিশ নির্বাচনই পাহারা দেয়, তাহলে বাকি পরিস্থিতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখব।
একই বক্তব্য দেন পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ডিআইজিও। এ ছাড়া অনেক পুলিশ সুপারই এ ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। তাদের মতে, ছয় ধাপে নির্বাচন করা পুলিশের জন্য অনেক বড় চাপ হয়ে যাবে। আরো কয়েক ধাপ বাড়ানো উচিত বলে মত দেন তারা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা অনেকটা সুবিধাজনক হবে।
সভায় বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, সব বিজিবি যদি নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত হয়ে যেতে পারে। এ দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিজাইডিং অফিসারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
বরিশাল বিভাগের এক পুলিশ সুপার বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, রিটার্নিং অফিসাররা স্বজনপ্রীতি দেখান। আর প্রিজাইডিং অফিসাররা খুব সহজে ম্যানেজ হয়ে যান। দেখা গেল- বাইরে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। ভেতরে প্রিজাইডিং অফিসার অনৈতিক কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে এক জায়গার প্রিজাইডিং অফিসারকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। এমনকি ভোট কেন্দ্রের ভেতরটাও পুলিশকে নজরদারির করার সুযোগ দেয়া উচিত।
এ এসপি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন লোক গ্রেফতার করার জন্য আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। এ নিয়ে আমরা ঝামেলার মধ্যে আছি। আরেকজন এসপি বলেন, নির্বাচনবিষয়ক ট্রেনিংয়ে পুলিশকে রাখা হয় না। এটাতে পুলিশের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। তাহলে নির্বাচনী কাজে সহায়তা করা পুলিশের জন্য আরো সহজ হবে।
এ দিকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তার বক্তব্যে পুলিশের দিকে অভিযোগের তীর ছোড়েন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে পুলিশ সুপাররা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতাটা রেখে দেয়। এর মধ্যে জেলা প্রশাসককে সম্পৃক্ত করতে চায় না। এটা ভেবে দেখা উচিত।