“আমার গ্রাম এখন আমার শহর”

এবারের পূঁজোর ছুটিটা অনেকটা বেখেয়ালী আনন্দেই কাটিয়ে দিলাম। কিভাবে ছ’টি রাত কেটে গেলো টেরই পেলাম না। একেবারেই কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেইমানা টাইপের। পুরোটা মতলব উত্তর কে চষে বেড়ানো।

এক সময়ের খাল, বিল, নদীনালা বিধৌত ছিলো আমাদের এলাকা। পুকুরে হরেক রকমের দেশী সুস্বাদু মাছে ভরপুর ছিলো। দেশী কই, শিং, চিতল, বোয়াল, খইলসা, পাবদা, মেনী, চান্দা, টাকি, মাগুর, ফলি, শোল, গজার, পুটি, টেংরা, বাইম, বইচা, আইর, সরপুঁটি, বিভিন্ন মিঠা পানির মাছে সমৃদ্ব ছিলো আমাদের এলাকা। একটু বন্যা হলেই এলাকা ডুবে যেতো ফলে পানির সাথে চলে আসতো পলিমাটি আর প্রচুর মাছ। পুকুর ভর্তি মাছ পানিতে প্রায় সমান থাকতো। চারপাশে নদী বেষ্টিত হওয়ায় পানির, বন্যার আক্রোশ থেকে যখন মতলবকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে পরছিলো।
Read More News

১৯৬৪ সনে আমাদের এলাকার একজন প্রথিত যশা মেধাবী প্রয়াত আয়াত আলী ইন্জিনিয়ার সাহেব তৎকালীন সরকারের সাথে চাঁদপুর ধনাগোদা সেঁচ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহন করেন। চাঁদপুর শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিন পূর্বে পদ্মা মেঘনার সংযোগ স্হল, প্রায় ১৭৫৮৪ হেক্টর জমি নিয়ে প্রকল্প। উদ্দেশ্য ছিলো সুবিধা ভুগীদের প্রশিক্ষন, এলাকার ভৌত কাঠামো সংস্কার, সমন্বিত পরিবেশ বান্ধব বালাই ব্যবস্হাপনা, সম্পূর্ন বন্যা মুক্ত এলাকা সৃষ্টি, অধিক খাদ্য উৎপাদন, মাছের উৎপাদন, ব্যাপক বনায়ন সর্বোপরি এলাকার উন্নয়ন। ১৯৭৭ সনে এ, ডি, বি, সহযোগিতায় ও জাপানিদের সহযোগিতায় বাধের কাজ শুরু হয় ১৯৮৭-৮৮ সনে শেষ হয়। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সম্ভুক গতিতে এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম চলছিল।।

বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মতলব থানায় ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুত তাই নাগরিক শহরের সব নাগরিক সুবিধা, প্রতিটি ঘরে ঘরে। টিভি, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক ইস্তি, গ্রাইন্ডার, ওভেন, গ্যাসের চুলা সব বাড়িতে, অনেক বাড়িতে এসি। মোবাইল, ইন্টারনেট তো আজ হাতে হাতে।

টাকা জমা দেয়া, টাকা উঠানোর, টাকা খরচের জন্য সৃষ্ট হয়েছে উন্নত বাজার, প্রতিটি বাজারে আছে উন্নতমানের মানুষের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বিনোদন সামগ্রী, সাথে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি উপজেলা কমপ্লেক্সে, ইউনিয়ন পরিষদের কমপ্লেক্সের পাশে স্বাস্হ্যসেবা কেন্দ্র হাসপাতাল।

আগে এলাকায় একজায়গায় থেকে অন্যজায়গায় যেতে হাঁটার বিকল্প ছিলোনা, এখন যোগাযোগ ব্যবস্হা রাস্তা ঘাট এতো সুন্দর, সচল, সাজানো যে ঢাকায়ও এতো সুন্দর রাস্তা কমই আছে। চলাচলের জন্য অনেক বাড়িতে নিজস্ব গাড়ী, টমটম, সিএনজি অল্প টাকার বিনিময়ে একজায়গায় থেকে অন্যজায়গায় যেতে পারে। গ্রামের অলিগলি প্রায় সব রাস্তাই পাকা।

সরকারী অনুদানে ও নিজেদের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে অনেক সুন্দর স্কুল, কলেজ,মাদ্রাসা, খেলার মাঠ, চোখ ঝলসে যাওয়া রূপের মসজিদ প্রতি গ্রামের প্রতি মহল্লায়।

এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের রুচির ও উন্নয়ন হয়েছে যে বাড়িগুলো টিনের বা ছনের ঘর ছিলো সে গুলোর অস্তিত্ব নেই, হয়েছে প্রাসাদোপম অট্টালিকা শহরের অনেকের বাড়িকে হার মানায়।

একজন কর্মক্ষম মানুষের টাকা শুধু নিজ পরিবারের জন্য নয় এর দাবীদার এলাকার লোকজনও একটি সুন্দর মনোরম বাড়িঘর এলাকার পরিবেশকে আলোকিত করেদেয় মানসিকতাকে পরিবর্তন করে দেয় তাই একজনের দেখাদেখি আরেকজন উৎসাহিত হয়। ফেনসিডিল, ইয়াবা দেখে যেমন মানুষ আসক্ত হয় ভাল কাজেও মানুষ অনুপ্রানিত হয়। মতলবে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ষাটনলে পিকনিক স্পট আছে সাথে বকুল তলায় নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে বেশ ভাল লাগে একলাশ পুর থেকে মোহনপুর পর্যন্ত রিভার ড্রাইভ মনমুগ্ধকরও বটে। আর বাঁধের উপর দিয়ে বেড়ানোর আনন্দ ও মন কে প্রফুল্ল করে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইসতিহারের অঙ্গীকারের সফল বাস্তবায়ন আমাদের এলাকায়। প্রতিটি গ্রামে নগর সুবিধা বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাঁধের ভিতরে ও বাইরে মাশাআল্লাহ ব্যাপক ধানের উৎপাদন যাকে বলে বাপ্পার ফলন হয়েছে,মাছের চাষ ও উৎপাদন হচ্ছে প্রচুর এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীর চাহিদা ও পূরন হচ্ছে। হাঁস মুরগীর খামার থেকে ডিম, মুরগী, হাঁস, কবুতর, কোয়েলের ডিম পাওয়া যাচ্ছে। গাভীর খাটি দুধ, কোক, ফান্টা, চকলেট, আইসক্রিম, ঔষধ পত্র সব খাঁটি ফরমালিন মুক্ত সামগ্রী গ্রামে। আমার চাঁদপুর তো মাছের রাজ্য। কি নেই আমার এলাকায় তা ই ভেবে পেলাম না।

৪ঠা নভেম্বর এর পর মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। সন্তান সম্ভবা ইলিশা মায়েরা তাদের সন্তানদের আমাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে কিন্তু আমরা নাদান মানুষেরা ওদের সেই সুযোগ ও দিতে চাইনা। রাতের আধারে চুরি করে মাছ এনে গ্রামে বিক্রি করছে। একটু অপেক্ষা অবসান ঘটলেই রূপালী ইলিশেরা স্বাগত জানাবে।

তবে আমাদের এলাকার মাটি খুব উর্বর। সামাজিক বনায়ন শুরু হয়েছে, অনেকে আগে যেখানে শুধুই ধানের চাষ করতো সেখানে আম, জাম, লিচু, কলা, পেঁপে, মাল্টা, কাঁঠাল, লেবু, জাম্বুরা শাক সবজী বিভিন্ন ফল ও ফুলের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করছে। বন বনানীতে সমস্ত এলাকা মনে হয় যেন ম্যানগ্রোভ।

তবে আরো নজরদারি বাড়ালে এলাকার কর্তা ব্যক্তিগন নিজের, নিজের আত্মীয় স্বজনের আখের গোছতে ব্যস্ত না হয়ে সততার সাথে এলাকার প্রতি মনোযোগী হলে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ হবেনা বলেই বিশ্বাস।।

এলাকায় রয়েছে বিরাট ওয়াপদা ক্যানেল যেখানে বছরে সম্ভবত দুবার পানি সরবরাহ করা হয় বাকী সময়টা খালি পরে থাকে। ক্যানেলে মাছের পোনা ছেড়ে দিলে বড় হতে সময় লাগবেনা, ক্যানেলের পাশে ব্যাপক ভাবে সবজী, লাউ, কুমড়ো, সীম, করল্লা, বরবটি পেঁপের চাষ করা গেলে শাক সবজীর অভাব হবেনা। এ ছাড়া দীর্ঘ বেড়িবাধের পাশে বনায়ন করলে বাঁধ যেমন রক্ষা পাবে তেমনি তালগাছ, নারকেল গাছ,সুপারী গাছ লাগিয়ে দিলে সৌন্দর্য বর্ধনের সাথে সাথে ঝড় ঝন্জা বিক্ষুব্ধ এলাকায় প্রকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা হবে।

আমাদের মতলবে রয়েছে অনেক গুলো মরা নদী। যেখানে কস্তুরীতে ভরপুর এগুলো পরিস্কার করে জলাশয় সৃষ্টি করে দেশের যুব সমাজের হাতে দেয়া গেলে তারা আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ করে নিজেদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে পারে, মাদক থেকেও নিজেদের দূরে থাকতে পারে।।

বর্তমানে ভবেরচর থেকে কালীপুর নদীর উপর ধনাগোদা নদীর উপর ব্রীজের অনুমোদন হয়েছে ব্রীজ হলে ঢাকা থেকে মতলবে আসতে একঘন্টা সময় লাগবে।। এখন জিরো পয়েন্ট থেকে দু’ঘন্টার পথ।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মতো মনে হয়।
আমরা নৌকায় চড়ে এসেছি।
আমরা পায়ে হেঁটে এসেছি।
আমরা গাড়িতে চড়ে এসেছি।
এখন হেলিকপ্টারে করে আসছি।।

কিছু দূর্নীতিবাজ না থাকলে দেশ কোথায় চলে যেতো তা আল্লাহই জানেন।।

জেসমিন সুলতানা
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
সভাপতি
ঢাকাস্হ চাঁদপুর জেলা আইনজীবী কল্যান সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *