মা-বাবার পুরো সময়টাই কাটে শিশুকে নিয়ে। এত পরিশ্রম, পরিকল্পনা, উদ্যোগ, স্বপ্ন-এর বিরাট অংশ জুড়েই আছে শিশু। যে ঘরে শিশু নেই সে ঘরটিতে যেন বড় ধরণের অপূর্ণাঙ্গতা রয়ে গেছে। এত ভালোবাসা, এত সাধনার ধন শিশু, তাকে বড় করে তোলা কিন্তু সহজ নয়। বড়রা শিশুদের কাছে যেমনটা প্রত্যাশা করেন, শিশু কিন্তু অনেক সময় তেমনটা করতে আগ্রহী থাকেনা। তখন অভিভাবকেরা দুঃখিত হন, বিরক্ত হন, হন আশাহত। কেন হয় এমনটা ?
জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে শিশুরা বড়দের অবাধ্য হয়। এটা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। এর মাধ্যমে শিশু বড়দের প্রত্যাশা ও আগ্রহের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠে। সে তার নিজস্ব সত্বা সম্পর্কে ধারণা পায়। গড়ে উঠে তার নিজস্ব সত্বা। মানব প্রজাতির বিকাশে বৈচিত্রের কোন বিকল্প নেই। ব্যক্তিত্বের কার্বণ কপি দরকার নেই। দরকার নতুন ধরণের মানুষ।
Read More News
মাঝে মাঝে এই ধরণের অবাধ্যতা অল্পতেই মিটে যেতে পারে। আবার কখনো কখনো এটা তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠে। তখনই এটা সমস্যায় পরিণত হয়।
অনেক কারণে শিশু অবাধ্য হয়
* কোন কোন শিশু ও কোন কোন অভিভাবকদের মেজাজ জন্মগতভাবেই বেশ চড়া থাকে, তারা বেশ অস্থির, হটকারী ও অল্পতেই বিরক্ত হয়।
* শিশু তার স্বাধীনতা প্রকাশের অংশ হিসাবেও বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে।
* একক অভিভাবক অথবা যেসব বাবা-মা চাপের মধ্যে আছেন তাদের আচরণ বাচ্চাদের মধ্যে অনেক সময় অনিশ্চতয়তা, নিরাপত্তাহীনতা বা রাগ তৈরী করে যার ফলে তারা অবাধ্য হতে শুরু করে।
* অন্যদের অবাধ্যতা দেখেও শিশু অবাধ্যতা শিখতে পারে।
* বাবা-মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক যদি তেমন ভাল না হয়, বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে যদি তারা তাকে যথেষ্ট গুণগত সময় দিতে ব্যর্থ হন, তখন শিশুর মধ্যে তাদের প্রতি অবাধ্যতা দেখা যায়।
* অনেক সময় অবাধ্যতা করে শিশু সুবিধা পায়। ফলে সে অবাধ্যতাই শিখে। এমনও হতে পারে যে, সাধারণভাবে সে তার সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেনা। কিন্তু আচরণ খারাপ করলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তার চাহিদা বড়রা মেনে নেন। শিশু যখন ভাল আচরণ করে তখন অভিভাবকেরা তার প্রতি মনোযোগী হননা। কিন্তু খারাপ আচরণ করলে তারা তার প্রতি নেতিবাচক মনোযোগ দেন। বকাঝকা করেন। সে এই মনোযোগ পছন্দ করে। ফলে সে আরো বেশী করে অবাধ্য আচরণ করে।
শিশুর অবাধ্যতা দূর করার জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নিন
* আপনার পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে কতটা সন্মান করে তা দেখুন। যদি তারা একে অপরের সাথে অসৌজন্য করে তবে শিশুও তা শিখবে। শিশু সব আচরণই দেখে শিখে। পরিবারের সদস্যরা সৌজন্য বজায় রাখলে শিশুও সৌজন্য শিখবে।
* বড়দের উচিত একে অপরের মূল্যবোধ, ধারণা, ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে সন্মান করা। তবে শিশুরাও এমনটা করতে শিখবে। বড়দের শিশুর জন্য রোল মডেল হয়ে উঠতে হবে। তাদেরকে তাদের বড়দের মান্য করতে হবে। নিজে খারাপ ব্যবহার করে শিশুর কাছে সৌজন্য আশা করাটা বৃথা।
* পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন বাড়াতে হবে। মনোমালিন্য তৈরী হলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা ভাষা ব্যবহারে সংযত হবেন। তারা কথা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করবেন। কোন কথার মানে দাঁড় না করিয়ে কি বলতে চান তা পরিষ্কার করে বলে ফেলবেন। অন্য সদস্যদের কোন কাজে তার অসুবিধা হলে তা মুখে বলবেন ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেন।
* শিশু ভাল আচরণ করলে তাকে পুরষ্কৃত করুন; যেমন, আদর করুন, প্রশংসা করুন, পছন্দের জিনিস কিনে দিন। শিশুদের পছন্দমতো খাবার দেয়া, খেলনা কিনে দেয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, প্রশংসা, আদর এসবই পুরষ্কার হিসাবে কাজ করে।
* যতটা সম্ভব শিশুর খারাপ আচরণ উপেক্ষা করুন। কোন ধরণের মনোযোগ না পেলে খারাপ আচরণ কমে যাবে।
* শিশু-কিশোররা হুমকি দিয়ে বা খারাপ আচরণ করে যাতে লাভবান না হয় তা নিশ্চিত করুন। যেমন, হুমকি দিলেও তার হুমকির কাছে নতি স্বীকার করে তার চাহিদা পূরণ করবেন না।
* ছোট বেলা থেকেই শারীরিক ও দলীয় খেলায় শিশুকে উত্সাহিত করুন। শিশুর বিকাশে খেলার গুরুত্ব অনেক। বয়স উপযোগী খেলার ব্যবস্থা করুন। খেললে খারাপ আচরণ করার জন্য শিশু কম সময় পাবে।
* বাবা-মা ও অভিভাবকেরা একমত হয়ে শিশুর উপর পারিবারিক শৃঙ্খলা আরোপ করবেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, শৃঙ্খলা সবার ক্ষেত্রেই যাতে সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়।
* শিশু-কিশোরদের কথা গুরুত্বসহ শুনুন ও বিবেচনা করুন। যদি আপনি তাদের সাথে ভিন্নমত হন তবে তাদেরকে ভিন্নমতের কারণ ব্যাখ্যা করে বলুন।
* শিশুকে মারবেন না।
* শিশুকে ভয় দেখাবেন না।
* শিশু-কিশোরদের ভালবাসুন। দুষ্ট বাচ্চাদের বা সমস্যাপূর্ণ বাচ্চাদের স্নেহ-ভালোবাসা আরো বেশী প্রয়োজন।
* এছাড়া শিশু বা অভিভাবকদের যদি রাগের সমস্যা থাকে বা কোন মানসিক সমস্যা থাকে তবে তার যথাযথ চিকিত্সা নিশ্চিত করতে হবে।
* শিশুকে কিছু করতে বললে তা কার্যকরভাবে বলতে হবে। তবেই তার নির্দেশনা মেনে চলার সম্ভাবনা বাড়বে।
* শিশুকে নির্দেশনা দেবার সময় ভদ্রভাবে সৌজন্যের সাথে দিতে হবে। এজন্য-একাজটি করে দাও প্লিজ-এভাবে বলা যায়। নির্দেশনা দেবার সময় চিত্কার করে বা খারাপ ভাষায় বলবেন না। তার কাছাকাছি গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে তাকে নির্দেশনা দিন। নিশ্চিত হোন যে, আপনার কথায় সে মনোযোগ দিয়েছে। সে যদি টিভি দেখতে থাকে বা খেলায় ব্যস্ত থাকে তবে সম্ভব হলে তার এই কাজটি একটি পর্যায় পর্যন্ত শেষ হতে দিন। এরপর টিভি বা খেলা বন্ধ করে তারপর নির্দেশনা দিন।
* যে শিশু বড়দের কোন নির্দেশনা মানতে চায়না তাকে নির্দেশনা দেবার সময় এটি মানতে উত্সাহিত করতে হেসে, পিঠ চাপড়ে বা কৌতুক করে নির্দেশনা দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
* শিশুকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর আপনি আপনার কাজে যেতে পারেন। এরপরও তার কাজের ধারাবাহিকতার দিকে লক্ষ্য রাখুন। অনেক সময় শুরু করেও সে কাজ থামিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তাকে আবার কাজটি শুরু করতে বলুন।
* নির্দেশনা দেবার পর শিশু যদি বিভ্রান্ত বোধ করে নির্দেশনাটি এবং কেন এটি দেয়া হচ্ছে এই বিষয়টি শিশুকে সহজ ভাষায বুঝিয়ে বলুন। একবার বুঝিয়ে বলাই যথেষ্ট। এরপর প্রয়োজনে দৃঢ়তার সাথে নির্দেশনাটি পুনরাবৃত্তি করবেন। আর ব্যাখ্যা করবেন না।
* শিশুকে একটি কাজ থেকে অন্য কাজে সরিয়ে নিতে হলে তাকে অন্ততঃ পাঁচ মিনিট আগে বলুন। তাকে মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় দিন। এরপরও দুই মিনিট আগে আরেকবার মনে করিয়ে দিন। এরপর তাকে সে যে কাজটি করছে তা থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কাজে লাগান।
* শিশুকে নির্দেশনা কিভাবে দিবেন তা শিশুর বয়স, বুদ্ধিমত্তা, বা কোন প্রতিবন্ধীতা (শারীরিক বা মানসিক) আছে কিনা তার উপর নির্ভর করে। বোঝার ক্ষমতার অভাব থাকলে অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় একেকবারে একটি করে নির্দেশনা দিতে হবে।
সবশেষে মনে রাখা দরকার যে, শিশু প্রতিটি ক্ষেত্রে বড়দের সব আদেশ নির্দেশ মেনে চলবে এমনটা আশা করা যায়না। তার অবাধ্যতা একটা মাত্রার মধ্যে থাকলেই হলো। লক্ষ্য রাখুন আপনি শিশুর থেকে খুব বেশী প্রত্যাশা করছেন কিনা। শিশুর মধ্যে সাধারণ চঞ্চলতা থাকে। কিশোর-কিশোরীদের বিকাশের অংশই হচ্ছে বড়দের প্রতি একধরণের বিদ্রোহী মনোভাব। মনের মধ্যে তাদের কিছুটা অবাধ্যতা মেনে নেবার মতো উদারতা রাখুন। শিশুদের অবাধ্যতার ক্ষেত্রে উপরের পরামর্শগুলো অনুসরণ করে দেখুন। তবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অতিরিক্ত কঠোর হবার প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতি বেশী জটিল হতে শুরু করলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন।