বাংলাদেশের একমাত্র সিডিএমএ মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেল (প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড) বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটির সব মিলে ৮৭৬টি টাওয়ারের (বিটিএস) মধ্যে প্রায় ৭০০টি বন্ধ হয়ে গেছে। অধিকাংশ টাওয়ার বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার কারণে। নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সিটিসেলের গ্রাহকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এদিকে গ্রাহকদের চাপ ও অফিস ভাড়া দিতে না পারায় দেশের অধিকাংশ গ্রাহক সেবাকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে সিটিসেল কর্তৃপক্ষ।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ সিটিসেল টাওয়ারের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে সিটিসেল মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক না থাকায় গত দুই মাস ধরে মির্জাপুরে অপারেটরটির কয়েক হাজার গ্রাহক চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। গ্রাহকরা জরুরি প্রয়োজনে কোনো অপারেটরের সঙ্গে কথা বলা এমনকি মডেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারও করতে পারছেন না।
Read More News
মির্জাপুর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ জেনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত রায় জানিয়েছেন, মির্জাপুরে সিটিসেল মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের বিদ্যুৎ বিল গত ৬ মাস ধরে বকেয়া রয়েছে। বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার টাকা। বকেয়া বিল পরিশোধ করার জন্য মির্জাপুর পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিস সিটিসেল মোবাইলের কর্মকর্তাদের বারবার অনুরোধ করার পরও তারা বিল পরিশোধ করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে টাওয়ারের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিল পরিশোধ না করা পর্যন্ত তারা টাওয়ারে লাইন পুনঃসংযোগ দেবে না বলেও জানান। মির্জাপুর উপজেলার মতো সারা দেশে প্রায় একই চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রায় এক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় সিটিসেলের বিটিএস ও গ্রাহক সেবাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে আছে। ফলে দ্রুতগতিতে গ্রাহক কমছে। কমছে রেভিনিউ। সেই প্রভাব পড়ছে সিটিসেলের ৫৪৩ জন স্থায়ী কর্মীর ওপর। এ বছরের শুরুর মাস থেকেই বেতনে অনিয়ম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনও তিন মাসের বেতন বন্ধ রয়েছে। শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে বলে গুঞ্জন ওঠার সাথে সাথেই সেখানে ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। এখন নতুন বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিসেলের কয়েকজন কর্মী বলেছেন, অর্থ সঙ্কটের কারণে আপাতত ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে সব বিটিএস বন্ধ করে দিতে পারে কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ বিলের মতো সামান্য টাকা দিয়ে যখন টাওয়ার চালু করতে পারছে না তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে সিটিসেলের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, মোবাইল ফোন অপারেটরদের গাইডলাইন অনুযায়ী ন্যূনতম যে কয়েকটি বিটিএস না থাকলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে সে কয়েকটি চালু রেখে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে অপারেটরটি।
বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার কারণে সিটিসেলের টাওয়ার বন্ধ হলেও এরচেয়ে বড় দেনা রয়েছে বিটিআরসির কাছে। গত বছরের নভেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে টুজি লাইসেন্সের আওতায় তরঙ্গ বরাদ্দ ও নবায়ন ফি বাবদ পাওনার পরিমাণ ২২৯ কোটি টাকা।
এছাড়া রাজস্ব ভাগাভাগি বাবদ পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, তরঙ্গ বরাদ্দ চার্জ বাবদ ১৯ কোটি ৭৫ লাখ, সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের ৭ কোটি ৪৫ লাখ ও লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ কোটি টাকা। আর্থিক সংকটের কারণে এ অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে জানিয়েছে সিটিসেল। এজন্য একাধিকবার অর্থ পরিশোধের সময় বৃদ্ধির আবেদনও করে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে সিটিসেলের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।
এসব ব্যাপারে জানতে সিটিসেলের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স তাসলিম আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে সিটিসেল অর্থ সংকটে রয়েছে। শিগগির এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কবে থেকে বিটিএস চালু হবে বা অর্থের জোগান হবে সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। কারণ অর্থের বিষয়ে টপ ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ থেকে কোন স্টেটমেন্ট পেলে আপনাদের জানিয়ে দিবো। আর আপাতত আমাদের কোন কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা নেই।’
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে বিটিআরসি থেকে টেলিযোগাযোগ সেবার লাইসেন্স পায় সিটিসেল। যাত্রার সময় এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সেলফোন কোম্পানি। প্রথম থেকে সিটিসেল বাংলাদেশের একমাত্র সিডিএমএ মোবাইল অপারেটর হিসেবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিটির বর্তমানে ৪৫ শতাংশ মালিকানা সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি সিংটেলের আর ৫৫ শতাংশ মালিকানা দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক গ্রুপ ও ফারইস্ট টেলিকমের।
বর্তমানে সিটিসেলের মার্কেট শেয়ার ১ শতাংশও নেই। ২০০৭ সালে সিটিসেলের মার্কেট শেয়ার ছিল ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে সিটিসেলের মার্কেট শেয়ার ছিল ৩.৮৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে কিছুটা বাড়লেও ২০১০ সালে কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩১ শতাংশে। ২০১১ সালে হয় ২ দশমিক ২৬ শতাংশে আর ২০১২ সালে এসে দাঁড়ায় ২.০১ শতাংশে। ২০১৩ সালে সে মার্কেট শেয়ার ১ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে আরও অর্ধেকে নেমে আসে।
সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা এখন শূন্যের কোঠায়, সারাদেশে ৮৭৬টির মধ্যে ৭০০ বিটিএস বন্ধ, সারাদেশে অধিকাংশ গ্রাহক সেবাকেন্দ্র বন্ধ, কর্মীদের তিন মাসের বেতন বকেয়া, নতুন ট্রেড ইউনিয়নের চাপ, বিটিআরসির কাছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বকেয়া, বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণসহ নানান সংকটের কারণে অপারেটরটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সিটিসেলে কর্মরত শ্রমিক নেতারা এই নিয়ে কয়েক দফায় টপ ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলার জন্য দফায় দফায় সময় চেয়ে আবেদন করলেও তাদের কোন সময় দেওয়া হয়নি বলে তারা অভিযোগ করেছেন।