এক আপুর সঙ্গে আমার ফেসবুকে পরিচয়। স্যানিটারি প্যাড ইভেন্ট নিয়ে নোয়াখালী গেলাম যেবার। কিছু সাহায্য লাগলেই ওই আপুকে নক দেই। আপু দেখতে স্মার্ট, এবং ১০০ লোকের মধ্যে ৯০ লোকের রায় হবে, আপু সুন্দরীও। সেই অর্থে পুরুষ গুণগ্রাহীর সংখ্যাও কম না।আজ ওয়েস্টিন, কাল রেডিসনে বুফে খাওয়ানোর দাওয়াত দেওয়ার মানুষেরও অভাব নেই। এর মধ্যে একজন ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলের চিকিৎসা বাবদ টাকা তোলার দায়িত্ব পড়লো আপুর ওপর।
যে লোক আপুকে ওয়েস্টিন খাওয়াতে চেয়েছিল, আপু তাকে সবিনয়ে বললো, “ওয়েস্টিনে খাওয়াতে চার থেকে পাঁচ হাজার খরচ হবে। আমাকে খাওয়াতে হবে না, আপনি টাকাটা দিয়ে ইভেন্টে সাহায্য করুন”। ছেলেটা পরদিন থেকে আপুকে আর নক করে না। ব্লক কিংবা আনফ্রেন্ড করেছে কিনা জানি না।
আরেক লোকের কথা ছিল, ‘ছেলেকে হেল্প করবো এক শর্তে যদি খেতে চলো ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে’। সেবারও আপুর কথা, “ঐ টাকাটা দিয়ে দেন এই ইভেন্টে। ছেলেটা বাঁচবে”। সেই লোকটিও পগার পার। আপু আজকাল উটকো লোক প্রেম করতে এলে এক একটা ইভেন্ট ধরিয়ে দেয়।
Read Our Latest News
চট্টগ্রামের আলোচিত নারী রিকশা চালক ফাতেমা খালাকে আমরা ঈদে একটা রিকশা কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এর জন্য টাকা তোলার সময় অনেকেই বলেছে, ‘দোকান করে দাও, পানের বিজনেসে বসাও’।
১১ বছর ধরে কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করছে, সে কি চাষবাস করতে পারবে? ধরলাম পারবে! কিন্তু সেটা শিখতে যে সময় লাগবে, ঐ সময়টা কে তাকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করবে?
ফাতেমা খালা ১১ বছর ধরে রিকশা চালিয়েছে, স্বাধীন জীবন খুঁজে পেয়েছে। আজ তাকে সাহায্য করতে চাইলাম বলে হাজার কথা!! আমিও তাই ঐ আপুর মতো করে বললাম, “আমরা রিকশা দিচ্ছি! চাইলে আপনি দোকান দিতে পারেন”। আর রিপ্লাই নেই।
আচ্ছা, আমরা কি কথাই বলি বেশি? আমরা কি অধিকার আদায়ে হুদাই প্রতিবাদ করি? একদিন কাকে জানি বলেছিলাম, “মানববন্ধন আর স্লোগানে কতটুকু রেভুলেশন আসে জানি না! কিন্তু রেভুলেশন আসে এক একটা স্টার্ট আপ কোম্পানিতে। রেভুলেশন আসে মেয়েদের দল বেঁধে গার্মেন্টস যাওয়াতে”।
সেভাবেই বলি, এই যে নারী অধিকার নিয়ে এতো কাজ করলাম, কী হলো! ফাতেমা খালা যখন আমাদের নিয়ে রিকশা ছুটে চললো, মন বলল, “এতো কথা বলে কতো মেয়েকে জাগাতে চেয়েছি। সমানাধিকারের জন্য চিল্লাফাল্লা করেছি। ফাতেমা খালা আপনিই জেগে আছে। পুরো রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে রিকশা ছুটে নিয়ে যাচ্ছে”।
রিকশা পাবার পর ফাতেমা খালা আমাদের জড়িয়ে কেঁদে দিয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম চেরাগিতে একটু ছবি-টবি তুলে রিকশা তুলে দিব খালার হাতে। কিন্তু কীসের কী! আমাদের রিকশায় তুলে দৌড়ে ছুটলো ফাতেমা খালা। হাজার হাজার ছেলেদের রিকশা রাস্তায় ছিল, কিন্তু ফাতেমা খালা হাসতে হাসতে ওদের পাস করল। আবার পিছন ঘুরে ওদের দেখিয়ে শিসও দিল। রাস্তায় মেয়েরা তখন হা হয়ে দেখছিল এক নারীর রিকশায় দুই নারী, আমি আর সৃজিতাদি। চেরাগিতে নন্দন বইঘরের সামনে তুলে দিলাম রিকশা। রিকশার সিটে বসে ছবি তুলছিলাম। ওখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ঊনিও এসে অংশ নিলেন আমাদের ফটোসেশনে।
সবশেষে ফাতেমা খালার হাতে ৫০০০ টাকা তুলে দিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, খুব ভাল আছেন তিনি। রিকশার খরচ আগে প্রতিদিন দিতে হতো ৩০০ টাকা। এখন শুধু গ্যারেজ ভাড়া দেন ১০০ টাকা। বাকি টাকা নিজের আর ছেলেমেয়েদের জন্য খরচ করেন।তবে বস্তিতে যেটা হয়, অনেক পুরুষ রিকশাওয়ালারা বলে, “তোর কপাল!”। আজীবন স্বাধীন নারীরা তো পুরুষের কাছে এসব শুনেই এসেছে। ফাতেমা খালাকে তাই সাহস দেই এগিয়ে যাবার জন্য।
আর এইটুকু কাজ না করে আমরা অনেকেই ফেবু গরম করতে ভালোবাসি, একে-ওকে লেঙ্গি দিতে ভালোবাসি। কেউ কাজ করলে সমালোচনা করতে ভালোবাসি! কিন্তু কতবার কাজ করার জন্য নিজে মাঠে নামি?
ভার্চুয়াল দুনিয়াটা অনেক বড়! চাইলে অনেক কাজ এখানে করা যায়! লেঙ্গি না মেরেও।
সবচেয়ে হাস্যকর মেসেজ পেয়েছিলাম এবার, “তুমি তো ধর্ম মানো না, নাস্তিক। ঈদ কী তোমার কাছে? কেন তুমি বলেছো ঈদের উপলক্ষে ফাতেমা খালাকে রিকশা দিচ্ছ। তোমার তো ঈদই নাই। ঈদ কেবল যারা মুসলিম, তাদের জন্য!” আমি দম ফেটে হেসেছি কিছুক্ষণ।
কাউকে ভালবাসতে গেলে ধর্ম লাগে না, ঈশ্বর লাগে না ভায়া। কারও জন্য কাজ করতে মুসলিম-হিন্দু-ইহুদি-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানও হতে হয় না! কেবল মানুষ হতে হয়!