মাওবাদী এলাকা দিয়ে শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গের ভোট গ্রহণ

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হতে চলেছে সোমবার থেকে। প্রথম দফায় মাওবাদীদের পুরনো ঘাঁটি এলাকা বলে পরিচিত জঙ্গলমহলের ১৮টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বারে বারেই উল্লেখ করেন যে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া আর পুরুলিয়া জেলা তিনটির জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে তিনি শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর কথায়, জঙ্গলমহল এখন হাসছে।
মাওবাদীরা এখন আর প্রকাশ্যে আসেন না ঠিকই, আবার রাস্তা আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কিছুটা যে গড়ে উঠেছে, তা খালি চোখেই দেখা যায়। কিন্তু একটু ঘুরলই চোখে পড়ে যে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া এখনও লাগে নি – যেখানে নেই রাস্তা, পানীয় জল বা কর্মসংস্থানের সরকারী ব্যবস্থা।
Read More News

বছর আটেক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ের নাম উঠে এসেছিল দেশ বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে। পুলিশের কথিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাওবাদীরা সংগঠিত করেছিল স্থানীয় মানুষদের – গড়ে উঠেছিল ‘পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটি’।
তারা ধীরে ধীরে গোটা লালগড় অঞ্চলকে নিজেদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করেছিল। দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল লালগড়।
বেশ কয়েকমাস পরে আধাসেনা বাহিনী পুনরুদ্ধার করেছিল এই এলাকা।
লালগড়, কাঁটাপাহাড়ী, ছোটপেলিয়া – মাওবাদীদের একসময়কার গড় এলাকাগুলোতে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকবছর পরে। এখন ঝাঁ চকচকে রাস্তা দিয়ে হরদম যাতায়াত করে পুলিশ আর আধা সেনা বাহিনীর গাড়ি।
বড়াগাদা গ্রামে ঢুকে অবাক হতে হয়েছিল – সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো গ্রামের রাস্তা! গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলছিলেন কয়েকবছর আগেও আত্মীয় স্বজনরা আসতে ভয় পেতেন, কারণ বছরভর হাঁটু অবধি কাদা থাকত গ্রামের রাস্তায়। তাঁরা যা পেয়েছেন, তা স্বপ্নেও কখনও ভাবেন নি। রাজ্যের মধ্যে সবথেকে বেশী পেয়েছে লালগড়, তাঁদের কথায়, বাচ্চা না কাঁদলে তো মা দুধ দেয় না।
বোঝাতে চাইছিলেন আন্দোলন করেছিলেন বলেই তাঁদের এলাকায় সরকার হাত উপুড় করে দিয়েছে।

মূল রাস্তাটা পিচের হয়েছে মাসখানেক হল। তবে ভেতরের দিকে এখনও কাঁচা রাস্তা। বর্ষার সময়ে সেই রাস্তা পেরিয়ে স্কুল যেতে পারে না বাচ্চারা, কামাই হয়।“
“তবে আমাদের গ্রামে সবথেকে বড় অসুবিধা হল পানীয় জলের। নলকূপগুলোর মধ্যে শুধু একটা – তা-ও প্রাথমিক স্কুলেরটা চলে। গোটা গ্রাম এখান থেকেই খাবার জল নেয়,” বলছিলেন বাসিন্দারা।
জানতে চেয়েছিলাম ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি দেওয়া নারেগা প্রকল্পের কাজ পাওয়া যায় কী না নিয়মিত? বাসিন্দারা বললেন,কাজের টাকা পেতে ছয়, আট মাস পেরিয়ে যায়।
তবে যে জিনিষটা লালগড়ে আসা কারোরই চোখ এড়াবে না, তাহলো সদ্য নির্মিত আমকলা সেতু – যেখানে আগে একটা কাঠের ব্রিজ ছিল – পরে যেটা মাওবাদীরা পুড়িয়ে দেয় নিরাপত্তাবাহিনীর যাতায়াত আটকাতে।
আরও চোখে পড়বে ওই সেতুরই কাছে নির্মীয়মাণ বিশাল বাড়ি – নার্সিং ট্রেনিং সেন্টার বা আরও একটু এগিয়ে দুবছর আগে চালু হওয়া লালগড় কলেজের নীল সাদা বিরাট বাড়িটা।
কলেজের অধ্যক্ষ বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী বললেন, বিরাট একটা অঞ্চলে আগে কলেজ ছিল না। অনেকেই এতটাই আর্থিকভাবে অসচ্ছল যে দূরের কলেজে ভর্তি হয়েও যাতায়াতের খরচ যোগাতে না পারায় পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এখন কাছাকাছি কলেজ হওয়ায় তারা আবারও পড়ার সুযোগ পেয়ে ভর্তি হচ্ছে।
জঙ্গলমহলের আরেকটি জেলা পুরুলিয়ার একটা শহর বান্দোয়ান। লালগড়েরর অনেক আগে এই অঞ্চলে মাওবাদীদের কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল।
মাওবাদী গেরিলাদের গুলিতে এই অঞ্চলে মারা গেছেন পুলিশ অফিসার, সি পি আই এম দলের নেতা-কর্মী – মাইন ফাটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পর্যটক আবাস। দুয়ারসিনির সেই পর্যটক আবাস এখনও সেই ধবংসাবশেষ হয়েই পড়ে রয়েছে।
একজন বাসিন্দা সন্তোষ কর্মকার বলছিলেন,পর্যটক আবাসটা যদি নতুন ভাবে চালু করত সরকার, তাহলে আবারও লোকজন আসত, দোকানগুলোতে বিক্রিবাটা হত, হাল ফিরত এলাকার।
মাওবাদী গেরিলারা হামলা চালিয়েছিল ভোমরাগড়া গ্রামেও। নিহত হয়েছিলেন সি পি আই এম দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা রবি কর। প্রায় দশ বছর পরে ওই গ্রামে আবারও ফিরে গিয়েছিলাম। বড় রাস্তা থেকে কিছুটা দূর অবধি পিচ রাস্তা হয়েছে, কিন্তু তারপরের অংশটা সেই মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তাই রয়ে গেছে – যেমনটা দেখেছিলাম দশ বছর আগে।
ভোমরাগড়ার কয়েকজন বাসিন্দা বলছিলেন, রাস্তা তো আগের মতোই আছে, কিন্তু সঙ্গে তৈরি হয়েছে পানীয় জলের ব্যাপক সমস্যা। নলকূপগুলোতে লাল রঙের জল ওঠে, কুয়োগুলোতে একফোঁটা জল নেই। পুকুরের জলে স্নানও করা যায় না। জল আনতে অনেকটা দূরে যেতে হয়।

ভোমরাগড়ায় যে বিরোধী সি পি আই এম দলের সমর্থন বেশী, তা জানাই ছিল। তাই খোঁজ করছিলাম ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের। পেয়েও গেলাম বান্দোয়ান শহরের কাছে। তাঁরা তখন তৃণমূলের চিত্রতারকা সংসদ সদস্য দেবের জনসভা থেকে ফিরছিলেন।
পানীয় জল, রাস্তা বা ১০০ দিনের কাজ করেও চার ছয় মাস টাকা না পাওয়া, সেচের কোনও ব্যবস্থাই না থাকায় বছরে একবার মাত্র ফসল হয়, এগুলো তাঁদের মুখেও শুনলাম। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের কাছেও একই অভিযোগ শুনে অবাকই হয়েছিলাম।
এর কারণটা জানতে চেয়েছিলাম পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী ও ঝাড়গ্রাম বিধানসভা আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সুকুমার হাঁসদার কাছে।
“এটা ঠিকই যে সীমিত সময়ে, সীমিত আর্থিক ক্ষমতায় সব জায়গায় সব কিছু পৌঁছিয়ে দিতে পারি নি। কিন্তু কিছু না কিছু কাজ সব জায়গায় হয়েছে – যেখানে রাস্তা দিতে পারি নি, হয়তো জলের সমস্যার সমাধান হয়েছে; যেখানে জল বা রাস্তা করে দিতে পারি নি, সেখানে অন্য কিছু কাজ হয়েছে। গোটা জঙ্গলমহলে তো সবকাজ ১০০ % পূরণ করা ৫বছরে সম্ভব না! তবে যেটুকু করতে পেরেছি, সেটাই রেকর্ড।“
বান্দোয়ানের সি পি আই এমের বিদায়ী বিধায়ক ও এবারের প্রার্থী সুশান্ত বেসরা প্রতিবাদ করলেন মি. হাঁসদার কথার।
“রাস্তা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, দু টাকা কেজির চাল – সবই তো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। রাজ্য সরকারের কৃতিত্বটা কোথায় এখানে! আর সবগুলো প্রকল্পই কিন্তু বাম আমলেই চালু হয়ে গিয়েছিল – সেটাও ভুললে চলবে না। আর মুখ্যমন্ত্রী যদি এত উন্নয়নই করে থাকবেন, তাহলে তিনি কেন রাস্তা দিয়ে আর জঙ্গলমহলে আসেন না – আগে যেমন আসতেন? কেন তাঁকে হেলিকপ্টারে চেপে ঘুরতে হয়?” প্রশ্ন সি পি আই এম প্রার্থী সুশান্ত বেসরার।
ওদিকে মন্ত্রী মি. হাঁসদা আরও দাবী করছিলেন যে তাঁরা সীমিত সময় আর অর্থের মধ্যেও এত উন্নয়নমূলক কাজ করেছন, যার ফলে মাওবাদীরা যে অনুন্নয়নের ইস্যুটা তুলে ধরেই এই জঙ্গলমহল এলাকায় নিজেদের ভিত শক্ত করতে পেরেছিল, সেই ইস্যুটাই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
যদিও মাওবাদীরা এখনও প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড চালায় না, বা তাদের শীর্ষ নেতা কিষানজী – যিনি গত নির্বাচনের আগে মমতা ব্যানার্জীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি মিজ. ব্যানার্জী সেই পদে আসীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ এনকাউন্টারে মারা যান। পুরনো মাওবাদী নেতা – কর্মীদের অনেকেই হয় জেলে, নয়তো নিহত হয়েছন। অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন, আবার অনেকেই আত্মসর্মপণ করেছেন সরকারী প্যাকেজ পাওয়ার আশায়।
শনিবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন এই অঞ্চলের দুই শীর্ষ মাওবাদী নেতা – নেত্রী – বিকাশ এবং তারা।
তবুও এখনও চাপা ভয় রয়েই গেছে মাওবাদীদের নিয়ে – তারা যে আবার ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে!
ভোটের আগে তাই গোটা জঙ্গলমহল মুড়ে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার চাদরে, যেরকম ব্যবস্থা করা হত মাওবাদীরা সক্রিয় থাকার সময়কার ভোটগুলোতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *