স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ। ভোটের পরও চলছে ভোট নিয়ে সংঘর্ষ। অনিয়ম-সহিংসতা অতীতের যেকোনো রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ভোটের আগের রাতেই গোপনে ব্যালটবাক্স ভর্তি করায় রক্ত ও প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও এই নির্বাচন নামের ‘প্রহসন’র পর নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব বলেও তিরস্কার করেছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউপি নির্বাচনে সহিংস ঘটনা, সিল মারার সংস্কৃতি দেখে আমার মনে হয়েছে সম্ভবত আমরা নির্বাচনী সংস্কৃতি ধ্বংস করে ফেলেছি।
তিনি বলেন, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার অধিকারের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। এটা কিভাবে ফিরে আসবে বা আদৌ ফিরে আসবে কিনা আমি জানি না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আগামীতে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এ বিষয়ে আমি হতাশাগ্রস্ত।
Read More News
তারেক শামসুর রেহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন নিয়ে আমরা অনেকবার কথা বলেছি। কিন্তু কমিশন পুনর্গঠন করলেই এই সংস্কৃতি থেকে ফিরে আসতে পারব তা আমার মনে হয় না। এর জন্য আমি রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়ী করব। রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে নীতিগতভাবে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনকে দলমুক্ত রাখতে হবে। তাদেরই নিয়োগ দিতে হবে যারা ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে। এখানে সহিংসতা মূলত আওয়ামী লীগের সাথে যখন বিদ্রোহী প্রার্থী থাকে তখন। যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে বিএনপি প্রার্থীর সহিংসতায় জড়িয়ে পড়াতো দূরের কথা পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেয়ার সাহস নেই, সেটা নির্বাচনের নামে এটি প্রহসন ছাড়া কিছু না। এ নির্বাচনে যে ফলাফল হচ্ছে এটা কোনো মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা না। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিজেদের অদক্ষতা, নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব আবার প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ নির্বাচনে কতটা কারচুপি হচ্ছে এটা যেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হয় সেজন্য গণমাধ্যমের ওপর চাপ রয়েছে। আমরা আগের উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে সহিংসতার খবর পাচ্ছিলাম এখন তা পাচ্ছি না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রশাসনের সামনেই ভোটকেন্দ্র দখল করে ভোট উৎসব করেছে। অনেক জায়গায় আগের রাতে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপেও অনেক স্থানে সহিংসতা হয়েছে। শিশুসহ অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে না পারার ব্যর্থতা সম্পূর্ণ ইসির। এ জন্য এর দায়ভার ইসিকে নিতে হবে। পরবর্তী ধাপগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে নির্বাচন স্থগিত অথবা প্রয়োজনে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে ইসি।
তিনি বলেন, বর্তমান কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। সামনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচন পরিচালনায় এ কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বৃহস্পতিবার যে ইউপি নির্বাচন হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই কমিশন শুধু নির্বাচন পরিচালনায় ব্যর্থ নয়। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিটাকে ধ্বংস করেছে। সামনের ইউপিগুলোতে যে ভালো নির্বাচন হবে এ কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রাণহানি কিছুটা কমেছে। এতে আত্মপ্রসাদ লাভ করার সুযোগ নেই। প্রতিটি নাগরিকের জীবন অমূল্য। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, ৮-৯ বছরের শিশুর তার স্কুলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এটি রীতিমতো ন্যক্কারজনক। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আশা করি না। আমরা আশা করি নির্বাচন আগামীতে আরো সুষ্ঠু হবে।
কলিমউল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশনের উচিত নির্বাচনের দিনগুলোতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে যাওয়া। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে হলেও তাদের হেলিকাপ্টার নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অনিয়মের কারণে ৩৩টি ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। ২২ মার্চের প্রথম ধাপে ৬৫টি কেন্দ্র বন্ধ হয়। ওই ভোট নিয়ে অন্তত ২৮ জন নিহত হয়।