বিশ্বের সবচেয়ে বড় কিছু হ্যাকিং এবং হ্যাকারদের কথা

এক.

হ্যাকিং নিয়ে বাংলাদেশে এখন যত কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে সব মিলিয়ে এই বিষয়ে হয়তো এতো কথা বলা হয়নি। এতোদিন হ্যাকিং শব্দটি ছিল আমাদের মতো মানুষের লেখালেখিতে, বিশেষ করে যারা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখি বা সংবাদ পরিবেশন করেন। দেশের ভেতর অল্প কিছু হ্যাকিং-এর ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়, তবে সেগুলো ছোটখাটো। কেউ কেউ কারো ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে, নইলে ব্যাংকের কার্ডের তথ্য চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে। কার্ড বিক্রির ব্যবসাটি বাংলাদেশে একদম খারাপ না। অর্থ্যাৎ আপনার কার্ড ইন্টারনেটে কেনা-বেচা হচ্ছে, আপনি হয়তো জানেনই না। এর থেকে বড় কোনো ঘটনা এখনও তেমন চোখে পড়েনি। তারপর যা ঘটলো তা একেবার বজ্রপাত। এতোবড় ঘটনা শোনার জন্যও বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না।
Read More News

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মতো করে বিভিন্ন সিস্টেমকে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করছেন। তবে সেগুলো যে পুরো বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন সেটা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেন না। আপনার বাসার ডেস্কটপ কিংবা যে ল্যাপটপটি দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, সেটা থেকে গোপনে যে কেউ আপনার সকল তথ্য নিয়ে যাচ্ছে না, তা অনেকেই হয়ত অবগত নন।
অনেকেই হয়ত মনে করেন, আমার আবার এমন কী তথ্য আছে যা অন্যের কাজে লাগতে পারে! হ্যাকাররা তথ্য সংগ্রহ করতেই থাকে। তারপর তারা দেখে কোনটা কোথায় ব্যবহার করা যাবে। ইন্টারনেট একটি আজব জায়গা। এখানকার ট্রাফিক এনালাইসিস করলে আপনার মাথা ঘুরাতে থাকবে। যেমন অনেকেই বিশ্বাসই করতে চান না যে, ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ট্রাফিক হলো পর্নগ্রাফি। তাহলে বুঝে দেখুন মানুষ কত বিশাল আকারে এটাতে অভ্যস্ত। এরকম অবাক করা অনেক বাস্তবতা আছে ইন্টারনেটে।
বাংলাদেশের ব্যাংকের টাকা ফেরত আসবে কি আসবে না এগুলো নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে নিশ্চই উত্তরগুলো পেয়ে যাব আমরা। কিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাক হলো, সেটাও হয়ত জানা যাবে। এই সুযোগে পাঠকদেরকে বিশ্বের বিশেষ কিছু হ্যাকিং প্যাটার্ন এবং হ্যাকারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না। এর থেকে হয়ত অনেকেই বুঝতে পারবেন, বর্তমান সময়ে কত জটিল কার্মকান্ড হয়; এবং আমাদের কেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বড় ধরনের কিছু হ্যাকিং-এর কথা। [তথ্যসূত্র: টেস্টেড.কম] ১. স্টাক্সনেট
আমরা সবাই জানি ইরান সম্প্রতি তাদের পরমানু কার্যক্রম বন্ধ করেছে। কিন্তু সেটা ঠেকানোর জন্য পেছনে আরো অনেক কিছুই করা হয়েছিল। তার একটি প্রজেক্ট হলো স্টাক্সনেট। পারমানবিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয় সিমেন্সের যন্ত্রপাতি। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে আমেরিকা এবং ইসরায়েল মিলে মাইক্রোসফট উইন্ডোজের ভেতর এমন একটি ওয়ার্ম (গোপন সফটওয়্যার) ঢুকিয়ে দিয়েছিল যা সিমেন্সের সেই যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকমতো কাজ করতে দিত না। মেশিনের চাকাগুলোকে বিভিন্ন গতিতে পরিচালিত করতো, কিন্তু অপারেটর সেটা বুঝতে পারতো না। তাকে দেখাত একটা ডাটা; আর আসলে চলছে আরেক ডাটা নিয়ে। ভয়াবহ ব্যাপার, বিশেষ করে সেটা যদি হয় পারমানবিক চুল্লীতে। এরকমভাবে যদি উল্টাপাল্টা কাজ করিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেখানে দূর্ঘটনা ঘটলে ইরানের কী হতো কে জানে! আরো ভয়ংকর হলো, এমন একটা দুটো ওয়ার্মের কথা আমরা জানি। এমন আরো অজস্র ওয়ার্ম বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করে রাখা হয়েছে।
২. আমেরিকার অস্ত্রভান্ডারে চীনের হানা
চীনের হ্যাকাররা আমেরিকার কিছু কিছু অস্ত্রভান্ডারের এক্সেস নিয়েছিল। তারা আমেরিকার মিসাইল প্রতিরক্ষা প্রোগ্রামের তথ্যসহ বেশ কিছু অস্ত্রের ডিজাইন চুরি করে নিয়ে যায়। এটা নিয়ে বারাক ওবামার সরকার তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। বিষয়টি নিয়ে চীনের সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে হয়েছিল।
৩. স্প্যামহাস এটাক
স্প্যামহাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ই-মেইল স্প্যামিং বন্ধ করে। তারা পৃথিবীর একটি অন্যতম বড় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। পুরো পৃথিবী থেকে এরা স্প্যাম ই-মেইলের তালিকা বানিয়ে সেগুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আমস্টারডামে অবস্থিত সাইবার-বাংকার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ই-মেইলকে এরা ব্ল্যাক লিস্ট করেছিল। এটা বুঝতে পেরে সাইবার-বাংকার পাল্টা প্রতিশোধ নেয়। সাইবার-বাংকার “ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়েল অফ সার্ভিস” (DDOS) আক্রমন করে; এবং প্রতি সেকেন্ড ৩০০ গিগাবাইট ইন্টারনেট ট্রাফিক পাঠাতে সক্ষম হয়। এতো বিশাল পরিমানে ট্রাফিক একদিকে পরিচালিত হওয়ার ফলে পুরো ইন্টারনেট ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এবং পুরো ইউরোপের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে পড়ে। এর ফলে সাইবার-বাংকারের কর্মকর্তা কামফাসকে স্পেন থেকে গ্রেফতার করা হয়। এবং তার কেসটি বিচারাধীন রয়েছে।
৪. কনফিকার
২০০৮ সালে ‘কনফিকার’ নামের আরেকটি শক্তিশালী ওয়ার্মের খোঁজ পাওয়া যায়, যা কোটি কোটি ওয়েবসাইটের সার্ভারে নিজেকে কপি করে রেখেছে। এটা এতোই শক্তিশালী যে, নিজেকে নিজে পাশের আরেকটি সার্ভারে কপি করে দিতে পারে। এটা এতো বিশাল আকারে ছড়িয়ে গেছে যে, এর দ্বারা ইনফেকটেড সার্ভারগুলো সবগুলো একত্রে যদি তাদের কম্পিউটিং ক্ষমতা ব্যবহার করে তাহলে এই গ্রহের যে কোনো সিস্টমকে মুহুর্তেই উড়িয়ে দিতে পারবে। তবে এখন পর্যন্ত এই গোপন সফটওয়্যারটি কারো কোনো ক্ষতি করেনি। এবং এর পেছনে কারা কাজ করছে, তা এখনও জানা যায়নি; শুধু বলা যায় এরা ‘গিফটেড প্রোগ্রামার’।
৫. অপারেশন গেট রিচ
এই পৃথিবীর বেশির ভাগ হ্যাকাররাই এই ধরনের কাজ করে থাকে ক্ষমতার জন্য। তারা নিজেদের স্বাক্ষর রাখতে চায়। তারা দাবি করে, তারা তাদের দেশকে ভালোবাসে। দেশের পক্ষে এরা লড়ে; নয়তো অন্যের শত্রুদের পিছু নেয়। কিন্তু কেউ কেউ সত্যি সত্যি টাকার জন্যই হ্যাকিং করে থাকে। তাদের একজন হলেন আলবার্টো গঞ্জালেস। তিনি এই থেকে টাকা বানাতে চেয়েছিলেন। তাই ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যেই তিনি প্রায় ১৭ কোটি (জ্বী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান) ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিলেন। তারপর তিনি নাম্বারগুলো নিজে ব্যবহার না করে খোলা বাজারে ইন্টারনেটে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেন। এটাই এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইডেন্টিটি চুরির ঘটনা। এর জন্য গঞ্জালেসের ২০ বছরের জেল হয়েছে।
৬. প্লে-স্টেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক
আমরা সবসময় ভাবি, প্রথাগত কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক হতে পারে। কিন্তু ২০১১ সালে সনি বুঝতে পেরেছিল যখন তাদের প্লে-স্টেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক হয়ে যাওয়ার বেদনা। প্রায় ৮ কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি হয়ে যায়। এবং ২০ দিন তাদের গেম নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তাতে সনির ১৭১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল। বিনোদন খাতে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা।
৭. কোমোডো হ্যাক
কোমোডো হলো সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যারা ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের আইডেন্টিটি নিশ্চিত করে। আপনি যখন গুগল, ফেসবুক, ইয়াহু ইত‌্যাদি ওয়েবসাইটে ভিজিট করেন, তখন ব্রাউজারে দেখতে পান একটি সবুজ রঙের চিহ্ন যা দিয়ে ভিজিটাররা বুঝতে পারে তিনি সঠিক গুগল/ফেসবুক সাইটে আছেন। কোনো ফেক পেজে ভিজিট করছেন না। কিন্তু ২০১১ সালেই কোমোডোর সিস্টেম হ্যাক করে একজন ইরানের হ্যাকার। তিনি সেখান থেকে বিখ্যাত সব ওয়েবসাইটের সার্টিফিকেট চুরি করেন। এরফলে তিনি গুগল এবং ফেসবুকের মতো দেখতে একটি সাইট বানিয়ে ভিজিটরকে বোকা বানাতে পারবেন যে, ওটা আসলেই গুগল কিংবা ফেসবুকের নিজস্ব সাইট। এভাবে গ্রাহকদের বোকা বানিয়ে অনেক তথ্য চুরি করতে পারেন।
৮. মেলিসা ভাইরাস
কম্পিউটারের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে যাওয়া ভাইরাস বলে ধারনা করা হয়। আমেরিকার নিউ জার্সি শহরের প্রোগ্রামার ডেভিড স্মিথ। তিনি তার কাজে বোরড হয়ে গিয়েছিলেন। তখন বসে বসে লিখে ফেললেন একটা ভাইরাস। এটাকে দেখে মনে হবে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের একটি ডকুমেন্ট। কিন্তু এই চোরা সফটওয়্যারটি নিজেকে আপনার ই-মেইল তালিকা থেকে প্রথম ৫০ জনকে নিজে নিজেই ইমেইল করে কপি করে দিতে পারত। ১৯৯৯ সালে প্রথম এটাকে একটি পর্ন সাইটে দেওয়া হয়। বোকা মানুষ এটাকে পর্ন ভিডিও ভেবে ডাউনলোড করে। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। এটাকে ঠেকানোর জন্য খোদ মাইক্রোসফট এবং ইন্টেলকে মাঠে নামতে হয়।
৯. প্যান্টাগনের নেটওয়ার্ক হ্যাক
এই গ্রহের সমস্ত হ্যাকারের নজর হলো প্যান্টাগন। আমেরিকার মিলিটারী নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে পারার স্বপ্ন দেখেন অনেকেই। অনেকেই হয়তো জানেন যে, ওই নেটওয়ার্ক থেকেই জন্ম হয়েছে বর্তমানের ইন্টারনেটের। ১৯৯৯ সালে ফ্লোরিডার একটি হাইস্কুলের ছাত্র জনাথন জেসম খুব সহজেই হ্যাক করে ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্সের নেটওয়ার্ক। এবং নিজের একটি সফটওয়্যার ওখানে ইনস্টল করে রেখে আসে। এর ফলে খুব সহজেই জেমস ওই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারত। জেমস অনেক গোপন ই-মেইল পড়তে পারত। এমনকি তার কাছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের অনেক ডাটা চলে আসে। এই অপরাধের জন্য তাকে ছয় মাসের হাউজ এরেস্টে রাখা হয় (কিশোর অপরাধী হিসেবে)। কিন্তু এর কয়েক বছর পরেই জেমস আত্মহত্যা করে।
১০. অপারেটশন শ্যাডি র‌্যাট
এই গ্রহের সবচেয়ে প্রত্যাশিত সাইবার আক্রমন হলো দূরে বসে অন্যের একটি কম্পিউটারকে দখল করে নেওয়া। এর থেকে চতুর বিষয় আর কী হতে পারে! এর ফলে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বসে ওই কম্পিউটারটিকে পুরোমাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। কথিত আছে ২০০৬ সাল থেকে চীনের সরকার এই ধরনের একটি প্রজেক্ট ব্যবহার করে যাচ্ছে যা নাম ‘অপারেশন শ্যাডি র‌্যাট’।
দুই.

হ্যাকার শব্দটি বললেই সব সময় আমাদের ভেতর এক ধরনের নেতিবাচক বিষয় চলে আসে। হ্যাকার মানেই খারাপ, যারা মানুষের ক্ষতি করে থাকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা নষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু প্রথম দিকে হ্যাকিং বা ক্রাকিং শব্দটা ইতিবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এই বিশ্বের এখনও একদল মানুষের কাছে হ্যাকিং হলো খুব স্মার্ট একটি বিষয়। খুব তারাতারিভাবে কোনো কিছু তৈরী করে দেখানোকে বলা হয় হ্যাকিং। নানান বিষয়ের অবতারণা করে যদি কোনো একটি সমস্যার সমাধান করে ফেলা যায়, তাহলে সেই স্মার্ট কাজটিই হলো হ্যাকিং। যদিও আমরা অনেকেই সেটা বুঝতে চাই না।
খারাপ হ্যাকারদের থেকে নিজেদের দূরে থাকতে পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে – একদিকে আছে ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স (যাদেরকে খারাপ অর্থে ব্যবহার করা হয়), আরেকদিকে আছে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার্স (যাদেরকে ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়)। হোয়াইট হ্যাট কিংবা সাদা টুপির হ্যাকারদেরকে অনেক সময় ‘ইথিক্যাল হ্যাকার’-ও বলা হয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ এরা তাদের মেধাকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে থাকে। ইথিক্যাল হ্যাকারদেরকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের সিস্টেম পরীক্ষা করার জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইথিক্যাল হ্যাকাররা নিজেদের পরিচয় উন্মুক্ত করেন না; কিন্তু সমস্যাগুলো বের করে নিজের ইচ্ছাতেই সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেন। তখন তারা সেগুলো ঠিক করে ফেলেন।
এখানে বিশ্বের কিছু ভালো হ্যাকারদের সম্পর্কে একটু বলা যেতে পারে যেন পাঠকদের কিছু ধারনা পরিষ্কার হয়।
ক). ষ্টিফেন ভজনিয়াক:
তিনি স্টিভ জবসের বন্ধু এবং অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। আমেরিকার সরকার তাকে বিভিন্ন সময়ে সন্মানিত করেছে; এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানিত ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেছে। প্রথম জীবনে তিনি একটি ব্লু-বক্স তৈরী করেছিলেন যা দিয়ে লং ডিসটেন্স টেলিফোন কলকে বাইপাস করে বিনা-পয়সায় কথা বলা যেত। সেই সময়ে টেলিফোন করার খরচ অনেক বেশি ছিল। একদিন একটা আর্টিকেল পড়ে তিনি তার বন্ধু স্টিভ জবসকে ডেকে নিয়ে আসেন। তারপর দু’জন তাদের কলেজে থাকতেই সেই ব্লু-বক্স তৈরী করে ফেলেন। ভজনিয়াক সেই বিনা পয়সার ফোন সিস্টেম দিয়ে পোপকে কল করেছিলেন; এবং নিজেকে হ্যানরী কিসিঞ্জার বলে পরিচয় দেন। ভজনিয়াক কলেজের লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। তারপর স্টিভ জবসকে নিয়ে কম্পিউটার তৈরী করেন। অ্যাপলের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের বেশিরভাগটুকু তৈরী করেন তিনি। তারা দু’জন প্রথম ১০০টি অ্যাপল কম্পিউটার ৬৬৬ ডলার দরে স্থানীয় ডিলারের কাছে বিক্রি করেন।
খ). টিম বার্নেস-লী
তিনি বহুল প্রচলিত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তৈরী করেন, যার মাধ্যমে আমরা এখন ইন্টারনেট ব্রাউজ করি, ফাইল শেয়ার করি এবং কোনো সাইটে তথ্য দেখি। তাকেও অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত পুরষ্কারটি হলো ‘মিলিনিয়াম টেকনোলজী প্রাইজ’।
ছাত্রজীবনে অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করার সময় তিনি এক বন্ধুর সাথে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করেছিলেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে কম্পিউটার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারপর নিজেই বিভিন্ন জিনসপত্র জোড়া দিয়ে একটি কম্পিউটার বানিয়ে নেন। তিনি ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্ন-এ কাজ করার সময় বিজ্ঞানীদের ফাইল আদান-প্রদানের জন্য হাইপারটেক্স প্রটোকলটি তৈরী করেন, যা পরবর্তীতে ইন্টারনেটকে পাল্টে দেয়। তিনি পরবর্তীতে আমেরিকার বিখ্যাত এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কনসোর্টিয়াম গঠন করেন, যারা বর্তমানের ওয়েবের স্টান্ডার্ট তৈরী করে থাকে।
গ). লাইনাস টরভাল্টস
তিনি আমাদের জনপ্রিয় লাইনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের জনক। তিনি ১৯৯১ সালে ‘মিনিক্স’ নামের একটি অপারেটিং সিস্টেম থেকে সাহায্য নিয়ে প্রথম লাইনাক্স কার্নেল লিখেন। তারপর তিনি অন্যান্য মানুষকে সেখানে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সহায়তা করার অনুরোধ করেন। এখন এই লাইনাক্স বিশ্বের সবচে বড় ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম যা বিনামূল্যে যেকেউ ব্যবহার করতে পারে। মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ কিংবা অ্যাপলের ‘ওএস এক্স’-এর মতো টাকা দিয়ে কিনতে হয় না। তাকে সন্মান জানানোর জন্য মহাকাশে একটি এস্টোরয়েডের নাম তার নামে দেওয়া হয়েছে। এবং টাইম ম্যাগাজিন ‘ষাট বছরের হিরো’-দের তালিকায় তাকে রেখেছে।
ঘ). রিচার্ড স্টলম্যান
এই পৃথিবীতে ফ্রি সফটওয়্যার প্রজেক্ট ‘জিএনইউ’-এর জনক হলেন স্টলম্যান। মানুষকে বিনা পয়সায় অপারেটিং সিস্টেম দেওয়ার জন্য তিনি এই প্রজেক্টটি তৈরী করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, মুক্ত সফটওয়্যার মানুষকে কম্পিউটার ব্যবহারে স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। তাই এমআইটি-তে থাকার সময় তিনি জিএনইউ তৈরী করেন। এমআইটি’র কম্পিউটার ল্যাবের এক্সেস নিয়ন্ত্রিত ছিল; যে কেউ যে কোনো সময় ব্যবহার করতে পারতো না। স্টলম্যান এটা ভালোভাবে নেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, যখন তখন কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারাটা একটা অধিকার। এমআইটি যখন পাসওয়ার্ড সিস্টেম বসায়, তখন তিনি সেটা হ্যাক করে সবার পাসওয়ার্ড ফেলে দেন; এবং সবাইকে জানিয়ে দেন যে, কম্পিউটার ব্যবহার করতে আর পাসওয়ার্ড লাগবে না। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অসংখ্য পুরষ্কার পান; এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চারটি অনারারী পিএইচডি ডিগ্রী প্রদান করে।
ঙ). সুটমো শিমোমুরা
তিনি নিজেই একজন বিখ্যাত হ্যাকার ছিলেন। কিন্তু আরেকজন বিখ্যাত হ্যাকার ‘কেভিন মিটনিক’ তার সিস্টেম হ্যাক করেছিল। এই ব্যক্তিগত আক্রমনের কারণে তিনি ক্ষেপে যান, এবং তার সহায়তাতেই এফবিআই কেভিন মিটনিককে আটক করতে সমর্থ হয়। শিমোমুরা কেমন কঠিন হ্যাকার ছিলেন তা বর্ণনা করেন বিখ্যাত লেখক ব্রুস স্টার্লিং। শিমোমুরা নাকি এমন ছিলেন যে, তার হাতে একটি মোবাইল ফোন দেওয়ার পর তিনি মুহূর্তেই সেটার অপারেটিং সিস্টেম পরিবর্তন করে ফেলেন, এবং একটু পরেই সেই ফোন দিয়ে হোয়াইট হাউজের অন্যান্য ফোনকলগুলো মনিটর করা যায়। এবং তিনি একজন এফবিআই এজেন্টের সাথে কথা বলতে বলতেই তার সামনেই এটা করেছিলেন। একজন সাংবাদিককে সাথে নিয়ে শিমোমুরা তার এই ঘটনাটির উপর একটি বই লিখেছিলেন। এবং পরবর্তিতে সেটা উপর নির্ভর করে একটি সিনেমা তৈরী হয়।
এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের অসম্ভব কম্পিউটিং ক্ষমতা রয়েছে। তারা যেকোনো সিস্টেমে এমনভাবে প্রবেশ করে যেতে পারে যা আমাদের সাধারন ব্রেইন বুঝতেই পারে না। তবে তেমন হ্যাকারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এগুলো খুবই ব্যতিক্রম ধর্মী ঘটনা। তবে এই গ্রহের বেশিরভাগ হ্যাকিং হয় কোনো না কোনো মাধ্যমকে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ) ব্যবহার করে। আমাদের নিত্যদিনের অসংখ্য বিষয়কে কাজে লাগিয়ে একজন হ্যাকার কারো সিস্টেমে প্রবেশ করে ফেলতে পারে। আর একবার একটি সিস্টেমে কারো এক্সেস থাকলে, যা ইচ্ছে তাই করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়টি আসলেই হ্যাকিং, নাকি অন্য কিছু তা হয়তো কিছুদিন পরেই বোঝা যাবে। বিষয়টি দেখার জন্য অন্য অনেকের মতো আমিও অপেক্ষা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *