ডিভোর্স বা সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি সম্পর্কে দুই জনের মাঝে ছাড়াছাড়ি নানা কারণেই হতে পারে। হয়তো মতের মিল না হওয়া, কিংবা পারস্পরিক সমঝোতার অভাব, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য জীবনে আকর্ষণের অভাব এর মত কারণগুলোই আসলে মুখ্য।
একটি ডিভোর্স যখন হয়ে যায়, তখন নারী-পুরুষ দুইজনের জন্যই ব্যাপারটা গ্রহণ করা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে আমাদের সমাজে ডিভোর্স ব্যাপারটাকে যেমন সহজভাবে নেয়া হয় না, তেমনি ডিভোর্স এর ভুক্তভোগীদের নিয়েও শুরু হয় নানান কানাকানি। যার কারণে অনেকেই শত সমস্যার মধ্যে থাকার পরেও ডিভোর্স এর মত সিদ্ধান্ত নিতে চাননা সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবেন সেটা চিন্তা করে।
Read More News
কিন্তু সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি আপনার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাই যদি ডিভোর্স ছাড়া আপনার সামনে আর কোনো পথ খোলা না থাকে, তবে দেরি না করে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করুন। ডিভোর্সের পর সবার আগে আপনার মাঝে যে জিনিসটি থাকা প্রয়োজন, তা হল আত্মবিশ্বাস। আপনাকে এখন থেকে একা একা সবকিছু করতে হবে – এই চরম সত্যটি সবার আগে মেনে নেয়ার চেষ্টা করুন। যখন নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী আর প্রস্তুত বলে মনে হবে, তখন সমাজের মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করুন।
১. সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানঃ
ডিভোর্স এর পর সমাজের বাঁকা চোখ অনেককেই ভীত করে। কিন্তু ভয় পাবেন না। মাথা উঁচু করে দাঁড়ান, নিজের পরিবারের কাছে কারণ ব্যাখ্যা করুন। তাদের সাপোর্ট নিন। কাছের মানুষদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করুন, কেন আপনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তা বুঝিয়ে বলুন। যদি কেউ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তির্যক কিছু বলে সেটিকে এড়িয়ে যান। কারণ তর্ক করা ছাড়াও আপনার অনেক কিছু করার আছে।
২. খুঁজে বের করুন আপনার মতই কাউকেঃ
ডিভোর্সের পর আপনার যেটা করা উচিত, সেটা হল বন্ধু বাড়ানো। যেহেতু একটা সম্পর্কের শেষ হয়েছে, সেখানে সেই সম্পর্কের জন্য হা হুতাশ করে জীবন নষ্ট করে দেয়ার কোন মানে নেই। এক্ষেত্রে বন্ধুদের সঙ্গ আপনাকে সাহায্য করবে। তাদেরকে সময় দিন, তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। বেড়াতে যান, আনন্দ করুন। খুব ভালো হয় যদি আপনার মত কাউকে খুঁজে পান। যদি পেয়েই যান তবে তার সাথে আপনার অনুভূতি শেয়ার করুন। তার অনুভূতির কথা শুনুন।
৩. নিজেকে সময় দিনঃ
আগেই বলা হয়েছে, ডিভোর্সের পর নিজেকে সময় দেয়া অত্যন্ত জরুরী। নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য, জীবনকে এখন থেকে কীভাবে সামনে এগিয়ে নেবে সেটার পরিকল্পনা করুন। আপনার জীবন, আপনার ক্যারিয়ারের মূল্য নিয়ে ভাবুন। ক্যারিয়ার যত ছোটই হোক তার অবশ্যই একটা মূল্য আছে। নিজেকে সময় দিন, নিজেকে নিয়ে ভাবুন। আপনার মূল্য কতটুকু সেটা নিজেকে বোঝান। অন্য কারো উপর যে আপনি নির্ভরশীল নন সেরকম মানসিকতা গড়ে তুলুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, “আপনি একা, কিন্তু একাকী নন” – এই বিশ্বাস নিজের মাঝে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করুন।
৪. পরিবারকে সময় দিনঃ
আপনার সঙ্গীর সাথে আপনার ছাড়াছাড়ির পর সবার আগে যেই ব্যাপারটি আপনার প্রয়োজন সেটা হচ্ছে পরিবারের সাপোর্ট। তাদের সাথে সময় কাটান। আপনার বাবা মা থাকলে তাদের সাথে গল্প করুন। যদি আপনার আর আপনার সঙ্গীর দাম্পত্য জীবনে সন্তান এসে থাকে তবে সন্তানকে সময় দিন। আপনার পাশাপাশি তাকেও মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন। তাদেরকে অপরজনের অভাব বুঝতে দেবেন না।
৫. পছন্দের কাজ করে সময় কাটানঃ
যখন আপনি একা জীবন যাপন করা শুরু করবেন, তখন দেখবেন আপনার অফুরন্ত অবসর সময়। অলস সময়ে অপরাধবোধের মত ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো যাতে আপনাকে ঘিরে ধরতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি দিন। বই পড়ুন, গান শুনুন। দুঃখের গান শোনা পরিহার করুন, আনন্দের সুরগুলো বেছে নিন। কোন শখ থাকলে সেদিকে মনোনিবেশ করতে পারেন।
৬. নিজেকে দোষ দেবেন নাঃ
আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডিভোর্সের পর ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। হয় ডিভোর্সের পেছনে কারণ হিসেবে দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেন, নয়তো অপরজনের ঘাড়ে তুলে দিয়ে নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতে থাকেন। দুটোই কিন্তু আপনার জন্য ক্ষতিকর। যদি আপনার সঙ্গীর সমস্যার কারণে আপনি ডিভোর্স নিতে বাধ্য হয়ে থাকেন তবে সেটা কখনোই আপনার দোষ নয়! আর যদি আপনার কারণে আপনার সঙ্গী আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে থাকেন তাহলে অনুতপ্ত হোন। আশা শেষ হয়ে যায় নি, অপরাধবোধে না ভুগে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। দরকার হলে মেন্টাল কাউন্সেলরের সাহায্য নিন। ভবিষ্যতে যাতে এমন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করুন। আপনি চাইলে আপনার সঙ্গীর কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। ডিভোর্সের পর ক্ষমা হয়তো আপনার সঙ্গীকে ফিরিয়ে আনবে না, কিন্তু আপনাকে মানসিক শান্তি দেবে।
৭. তাড়াহুড়ো করার কিছু নেইঃ
অনেকেই আছেন ডিভোর্সের পর নতুন সম্পর্কে জড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটি উচিত নয়। যদি ডিভোর্সের পর আপনি নতুন করে সম্পর্কে জড়ানোর পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে সেটা বাস্তবায়নের আগে পর্যাপ্ত সময় নিন। কারণ ডিভোর্সের পর পর আপনার সঙ্গীর সাথে আপনার সুন্দর অতীতগুলো আপনাকে পীড়া দেয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এটা খুবই সাধারণ বিষয়। নিজেকে প্রস্তুত করুন, পীড়াদায়ক অনুভূতিগুলোকে আস্তে আস্তে চলে যেতে দিন। কারণ তাড়াহুড়ো করে সম্পর্কে জড়াতে গেলে আপনি অস্বস্তিকর অনুভূতিতে পড়তে পারেন। যদি সেটা বাড়ে, তাহলে আবারও ছাড়াছাড়ির ভয় আপনাকে ঘিরে ধরবে। সেক্ষেত্রে নতুন সম্পর্কেও আপনি ভালো থাকতে পারবেন না। তাই এইসব ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করাই ভালো।
৮. আত্মবিশ্বাসী হোন, ভালো থাকুনঃ
জীবনের মাঝামাঝি সময়ে ডিভোর্সের পর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আত্মবিশ্বাসী থাকা। এই ব্যাপার থেকে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবেন এই বিশ্বাস থাকলে যে কোনো সমস্যা থেকেই উত্তরণের পথ আপনি খুঁজে পাবেন। অতীতে যা যা করেছেন সেগুলো নেয়ে চিন্তা করুন, কী কী ভুল করেছেন সেগুলো বের করুন। সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর পর এই ভুলগুলো যাতে আর না হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখুন।
৯. সম্পর্কে জড়ান সবকিছু জানিয়েঃ
যখন আপনি নিজেকে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে মনে করবেন তখনই সম্পর্কে জড়াতে পারেন। তবে সম্পর্কে যাওয়ার আগে আপনার নতুন সঙ্গীকে সবকিছু জানান। তার কাছে ব্যাখ্যা করুন, কেন আগের ডিভোর্সটি হয়েছে। যদি আপনার দোষ থেকে থাকে তাহলে সেগুলোও তাকে বলুন, এবং আশ্বাস দিন যে ভবিষ্যতে এমন কিছু হবে না। জোর করে কিছু করতে যাবেন না, তাহলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।
সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি মানুষের জীবনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যদি ছাড়াছাড়ি হয়েই যায়, ভেঙ্গে পড়বেন না। ভুল থেকে শিক্ষা নিন, সাহসী হোন। মানসিকভাবে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর জন্য প্রস্তুত হলে সেটা করুন। জীবন খুবই ছোট। আপনি হয়তো কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু তার জন্য পুরো জীবন ভাসিয়ে দেয়ার মানে নেই। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিন, ক্ষতিগুলো পূরণ করুন। সুখী থাকুন।