আঠারোর আগেই গণতন্ত্রের ইস্কুলে

সোমবার সকালে রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘স্টুডেন্ট কেবিনেট’ নির্বাচনের চিত্র এটি।

এই স্কুলের মতোই বাংলাদেশের ১৬ হাজার ৪২৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬ হাজার ৫৬৭টি দাখিল মাদ্রাসায় ‘মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে সোমবার সকাল ৯টা থেকে ভোট দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সকালে মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট কার্যক্রম ঘুরে দেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে পাশে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।

সকাল সাড়ে ৮টায় মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ভোটের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় ছাত্রীরা। সবার চোখ-মুখে উচ্ছ্বাস; আনন্দের ঝিলিক।

এই বিদ্যালয়ের মোট ১০টি বুথে ভোট নেওয়া হচ্ছে। ভোট দিচ্ছে এক হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থী।

সাংবাদিকের ভূমিকায় ভোটের সংবাদ সংগ্রহ করছে দশম শ্রেণির শামীমা আক্তার এশা। ভোট দেওয়ার অনুভূতি জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বললো, “১৮ বছরের আগেই ভোট দিতে পারছি, আমি খুব খুশি। নির্বাচনের আমেজ বুঝতে পারছি।”

Read More News

এশার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ‘সংবাদ’ সংগ্রহ করছে নুসরাত জাহান রাইসাও। শিক্ষামন্ত্রীর বিফ্রিংয়েও নোট নিতে দেখা গেল দুই ক্ষুদে সাংবাদিককে।

ভোট তথ্য

# দেশের মাধ্যমিক স্তরের ২২ হাজার ৯১১টি স্কুল-মাদ্রাসায় ভোট হচ্ছে।

# ভোট দিচ্ছে মোট ৯৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯৫ জন শিক্ষার্থী।

# এক লাখ ৮৩ হাজার ৯২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী পাঁচ লাখ।

শিক্ষক মেহেরুননেছা বলেন, “ভোটের আগের দিন রোববার টিফিনের সময় ও পরের পিরিয়ডে মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গতকাল খুবই এক্সাইটেড ছিল ওরা।”

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই ভোট হলেও বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীরাও মিছিলে হাত তুলে স্লোগান দিয়েছে বলে জানান তিনি।

নির্বাচনের প্রার্থীরা নিয়ম মেনেই স্কুল প্রাঙ্গণে রশিতে ঝুলিয়েছে হাতে আঁকা পোস্টার। হাতে তৈরি লিফলেটও বিলি করেছে তারা।

“প্রথমবার মিছিল করেছি, পোস্টার বিলি করেছি। ভোটও দেব এই প্রথম। সত্যিই ভালো লাগছে,” বললো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আসমিকা আমিন তুলি।

১০৯ নম্বর কক্ষে এক নম্বর বুথে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব সামলাচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণির নাবিহা জামান জাইমা। কেমন নির্বাচন হচ্ছে প্রশ্ন করতেই তার উত্তর, “সবই ঠিক আছে।”

এই কক্ষে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে রয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির জান্নাতুন নিসা মীম ও সাদিয়া নূর। অরণী রায় সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও তনিমা আহমেদ তন্নী পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পেয়েছে।

সবার মুখেই এক কথা; জীবনে প্রথমবার ভোটের দেখা পেয়ে, বড়দের মতো এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে সবাই দারুণ খুশি।

ভোট গ্রহণের ব্যস্ততার মধ্যে তাদের কেউ ব্যালট ছিঁড়ে দিচ্ছে, কেউ নখে লাগিয়ে দিচ্ছে কালি। আর এজেন্টরা লিস্ট মিলিয়ে ভোটারদের নাম কাটছে।

এই ভোটযজ্ঞে অষ্টম শ্রেণির লিলিয়া পেয়েছে পুলিশের দায়িত্ব। তার মতো মোট ৫০ জন আইন-শৃঙ্খলা সামলাচ্ছে।

পুলিশের কাজ কেমন লাগছে জানতে চাইলে সাজনিন আরেফিন রিতুর উত্তর, “ঠিকভাবে করলে পুলিশের কাজ ভাল।”

ভোট শুরুর আগে থেকে সব প্রার্থীকে বিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে অবস্থান করতে হচ্ছে।

ওই কক্ষে বসা অষ্টম শ্রেণির মেহজাবিন হোসেন বললো, “একটু নার্ভাস। তবে ফল যাই হোক, কোনো সমস্যা নেই।”

তার সঙ্গে থাকা অন্য প্রার্থীদেরও একই উত্তর। সবাই তারা বন্ধু; যেই নির্বাচিত হোক, কোনো অসুবিধা নেই।

 

স্টুডেন্টস কেবিনেট কী?

>> প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য আট সদস্যের এই কেবিনেট নির্বাচন করছে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা।

>> ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাই ভোটার। ভোটার তালিকাভুক্ত যে কেউ প্রার্থী হতে পারে।

>> প্রত্যেক ভোটার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির নেতা নির্বাচনে প্রতি শ্রেণিতে একটি করে ভোট দেবে। এছাড়া তিনটি শ্রেণিতে পছন্দের আরও তিন প্রার্থীকে ভোট দেওয়া যাবে।

>> প্রত্যেক শ্রেণি থেকে একজন করে পাঁচজন এবং সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিন শ্রেণির তিন জনকে নিয়ে হবে কেবিনেট।

কী করবে কেবিনেট?

>> শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সংরক্ষণ, পুস্তক ও শিক্ষা সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানিসম্পদ, বৃক্ষরোপণ ও বাগান তৈরি, দিবস পালন ও অনুষ্ঠান সম্পাদন, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন এবং আইসিটি নিয়ে কাজ করবে এই কেবিনেট সদস্যরা।

>> নির্বাচিত স্টুডেন্টস কেবিনেট প্রতিমাসে কমপক্ষে একটি সভা করবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে শিক্ষকরা পরামর্শ দেবেন।

>> ছয় মাস পর পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ক্যাবিনেটের সাধারণ সভা হবে।

কেন এই কেবিনেট?

>> শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, কিশোর বয়স থেকে গণতন্ত্রের চর্চা, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে এ আয়োজন।

> এ বিষয়ে গতবছর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “শিশু শিক্ষার্থীরা রাজনীতি শিখুক। আধুনিক যুগের জ্ঞান অর্জন ছাড়া কেউ নেতা হতে পারবে না।”

মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রওশান আরা বলেন, “মেয়েরা অনেক উৎসাহী। আর স্টুডেন্ট কেবিনেটও থাকা ভালো। এর মধ্য দিয়ে নতুন কিছু করার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।”
স্কুলের বাইরে অপেক্ষায় থাকা অভিভাবক নুরুদ্দিন মিয়া জানান, তার মেয়ে নুরজাহান আক্তার এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেই ভোট দিতে স্কুলে আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে সে। তাই অন্য দিনের চেয়ে আগেই তাকে স্কুলে নিয়ে আসতে হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার রুকাইয়া আলম মুন এই দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে ‘ধন্য’ মনে করছে। কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তার সংক্ষিপ্ত উত্তর, “নো।”

সিইসি রুকাইয়া জানালেন, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, ক্লাসের পারফরমেন্স, কথা বলার ধরন, নিয়মনীতির ওপর কতখানি শ্রদ্ধাশীল- এসব দিক দেখে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই বিচারে বাতিল হয়েছে ১২ জনের মনোনয়নপত্র।

গণতন্ত্র শেখার এই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “আমরা চাই তোমরা ভালো মানুষ আর অনেক বেশি জ্ঞানী হও।

“ছেলেমেয়েদের প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশ পরিচালনার জন্যও তাদের তৈরি করা প্রয়োজন।”

জ্ঞান ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের প্রসঙ্গ টানেন শিক্ষামন্ত্রী।

“জ্ঞান দিয়ে ওরা রিজার্ভের টাকা নিয়ে গেছে। তবে সেই জ্ঞান ও দক্ষতা কার হাতে পড়ল- সেটাই আসল কথা। আমরা চাই ছেলেমেয়েরা ভালো মানুষ হয়ে উঠুক।”

গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে মাধ্যমিক স্তরের এক হাজার ৪৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্টুডেন্ট কেবিনেট’ নির্বাচন হয়। আর ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিকের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘মন্ত্রিসভা’ গঠন করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *