বুয়েটের প্রথম নারী ভাইস চ্যান্সেলর খালেদা একরাম গ্র্যাজুয়েশন করেছেন বুয়েট থেকেই। এরপর কর্মজীবনও শুরু করেন বুয়েটে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এখন তিনি ভাইস চ্যান্সেলর। বাবা মো: একরাম হোসেন ছিলেন শিক্ষা বিভাগের একজন বড় কর্মকর্তা, মা কামরুন নেসা হোসেন আজিমপুর গার্লস স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস। স্বভাবতই শিক্ষক মায়ের সন্তানেরা সদা নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। বাবা-মায়ের চারটি মেয়েসন্তানের মধ্যে খালেদা একরাম ছিলেন তৃতীয়। বড় দুই বোন লেখাপড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িত ছিলেন বলে ছোট বোন খালেদাও তাদের সাথে ছবি আঁকতেন, গান করতেন। বাবা-মা দু’জনই প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলেন। তার পরও চার মেয়ের পড়াশোনা, আদবকায়দা, জীবনবোধের ব্যাপারগুলো একটু একটু করে বোঝাতেন, সন্ধ্যায় পড়াতে পড়াতে, কখনো রাতে খাওয়ার টেবিলে। বাবার আদরের মেয়ে যাতে জীবনচলার পথে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হন তাই। বাবা মো: একরাম হোসেন গল্পের ছলে বোঝাতেন জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আর বলতেন- নারী ও পুরুষ আলাদা কোনো ব্যাপার না, বরং মানুষ হিসেবে স্রষ্টার কাছে নারী-পুরুষ সবাই সমান। তাই খালেদা একরামের জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা হয়ে গিয়েছিল একেবারে ছোটবেলা থেকেই। মা বাংলার বিষয়গুলো পড়াতেন আর বাবা ইংলিশ- এভাবেই আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে ঢাকা বোর্ডে অষ্টম স্থান অধিকার করে খালেদা একরাম এসএসসি পাস করেন। হলিক্রস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে।
Read More News
বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খালেদা একরাম জানালেন- আমার বাবা ১৯৩৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন আর আমার মা ইস্ট বেঙ্গলের চতুর্থ মুসলিম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। তার নাম কিছু বইপত্রে এখনো উল্লেখ আছে।
১৯৬৮ সালে আমার বাবা ডেপুটি ডাইরেক্টর পাবলিক ইন্সট্রাক্টর হয়ে রিটায়ার্ড করেন। আমার বড় বোন কামেলা আক্তার ইসহাক ইংল্যান্ডে। কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে প্ল্যান্ট প্যাথলজিতে পিএইচডি লাভ করে ওখানেই বসবাস করছেন। মেজো বোন মোর্শেদা করিম বিবিসিতে সংবাদ পাঠক করতেন (পরে মারা যান)। ছোট বোন ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও মারা যান সন্তান হওয়ার সময়। বর্তমানে আমি ও আমার বড় বোন বেঁচে আছি। বাবা-মাও পরলোকগমন করেছেন। আমার তিন ছেলেমেয়ে; ওরাও দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে যার যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত।
কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম তার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর, শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে। তিনি বলেন, নিজের মনের শক্তিই কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি। ছোটবেলায় চার বোনই একসাথে পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা সবই করতাম। বড় দুই বোন সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত ছিল বলে আমারও সে ব্যাপারটি কেন যেন মন থেকে খুব টানত আর সে থেকেই মনের ভেতর পুষে রাখা শক্তি ও প্রেরণা আর্কিটেকচারে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। আমার বাবা-মা কখনোই নিজের ইচ্ছে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি, বরং আমরা কিসে ভালো করব, কিসে আমাদের আগ্রহ- সে ব্যাপারটা বোঝার জন্য পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। কোনো কিছুতে তাদের চাপাচাপি ছিল না। তবে মাগরিবের পর কেউ ঘরের বাইরে থাকা নিষেধ ছিল। মাঠে খেলতে গিয়ে সময়মতো বাসায় ফিরে পড়তে বসেছি। ১৯৭৪ সালে বুয়েট থেকে আর্কিটেকচারে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হওয়ার কিছু দিন পর লেকচারার হিসেবে বুয়েটেই জয়েন করলাম। এরপর ৪২ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়ে গেলাম। এরই মধ্যে প্রমোশন হয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসরসহ একবার Head of the Department, দুইবার Dean of the faculty (Faculty of Architecture and Planning) অবশেষে গত সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে Vice-Chancellor হিসেবে কর্মরত আছি। শিক্ষকতা জীবনের এক ফাঁকে Post Graduate Courses-এর জন্য ১৯৯২ সালে সুইডেনের University of Lund-এ ছিলাম। আর ১৯৮০ সালে MURP-এর জন্য University of Hawaii, Honolulu, Hawaii, USA-তে থাকতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কর্মবহুল এ জীবনে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে যে একটা মহৎ ও উজাড় করে সন্তানকে কিছু শেখানোর প্রচেষ্টা ছিল সেটা বুঝি পৃথিবীর আর কিছুর সাথে তুলনীয় নয়। আমি সৃষ্টিশীল বিষয়ে পড়াশোনা করেও নিজে তেমন কিছু প্রফেশনাল কাজ করিনি পড়ানো ছাড়া, তবে হাউওয়েতে পড়াশোনা করার সময় সামান্য কিছু প্রফেশনাল ডিজাইনের কাজ করেছি। তবে এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনো আফসোস নেই, বরং আমার অনেক ছাত্রছাত্রী আজ বিশ্বে নামকরা আর্কিটেক্ট। তাদের কাজ আমাকে বিমোহিত করে। সেটাতেই আমার আত্মতৃপ্তি।
একজন নারীকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে কোন কোন দিকে তার যোগ্যতা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শুধু মেয়ে হিসেবে বলব না, আমি বলব প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই জীবনধারণ ও জীবন দর্শনের কিছু চিন্তাভাবনা থাকা দরকার এবং এই চিন্তাভাবনা আমরা অনেক সময় অন্যের সৃজনশীল কাজ থেকে পাই- যেমন কবিতা, গান, চিত্রকর্ম, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস। যে সৃষ্টিতে যত ভাবের গভীরতা বেশি, সেটা কিন্তু জীবনে তত বেশি দোলা দেবে- আর একটা সময় সেটা থেকেই জীবনবোধ ও সেলফ অ্যাসেসমেন্টের ব্যাপারটি চলে আসে। এভাবেই একটা ছেলে বা মেয়ে নিজেকে তৈরি করার পথ খুঁজে পায়। নিজেকে বুঝতে পারতে হবে। আজকাল কিন্তু মেয়েরা অনেক বেশি রিজনেবল। আমার মনে হয় মেয়েরা অনেক বেশি কনসেন্ট্রেটও- কী করব আমি? যেটা ইয়াং ছেলেদের মধ্যে কমই দেখি। আমরা যদি ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তাদের প্রতি যদি একটু সহানুভূতিশীল হই তাহলে তারা অনেক বেশি ওপরে উঠতে পারবে। তাদের মধ্যে অনেক বেশি উদ্দাম-উচ্ছ্বাস দেখি, কখনো কখনো দেখি কেমন যেন ভুল করে ফেলছে হঠাৎ। এর জন্য তাদের আমি সরাসরি দায়ী করব না। এর জন্য প্রয়োজন বাইরের পৃথিবীর সাথে নিজেদের মেশানো। চার পাশে চোখ-কান খোলা রাখা। তাহলেই হয়তো ভুলগুলো শুধরে সার্বিকভাবে এগোতে পারবে।