সুন্দরবন আমাদের সৌন্দর্যের অহঙ্কার। ভ্রমণের জন্য সুন্দরবন ভ্রমণপিয়াসীদের কাক্সিক্ষত জায়গা। বছরের সব ঋতুতেই সুন্দরবন ভ্রমণ করে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ সম্ভব। সুন্দরবনের যাবতীয় খবর জানাচ্ছেন আলমগীর কবির
Read More News
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী প্রশস্ত বনভূমি, যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান নামে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে। জরিপ মোতাবেক ৫০০ বাঘ ও ৩০ হাজার চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সুন্দরবন পুরো পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের একটি হিসেবে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান যথেষ্ট জটিল। দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সীমানা। উঁচু এলাকায় নদীর প্রধান শাখাগুলো ছাড়া অন্য জলধারাগুলো সর্বত্রই বেড়িবাঁধ ও নিচু জমি দ্বারা বহুলাংশে বাধাপ্রাপ্ত। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের আয়তন হওয়ার কথা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গকিলোমিটার (২০০ বছর আগের হিসাবে)। কমতে কমতে এর বর্তমান আয়তন হয়েছে আগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান। বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গকিলোমিটার (বালুতট ৪২ বর্গকিলোমিটারের আয়তনসহ) এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের নদীগুলো নোনাপানি ও মিঠাপানির মিলনস্থান। সুতরাং গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠাপানি বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এ এলাকাটি। এটি সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চলজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সুন্দরবন অবস্থিত।
সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান ও কেওড়া। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইনের হিসাব মতে, সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে। প্রেইনের প্রতিবেদনের পর সেখানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণে এর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বনজ প্রকৃতিতে খুব কমই আনুসন্ধান করা হয়েছে এসব পরিবর্তনের হিসাব রাখার জন্য।
বদ্বীপীয় নয়, এমন অন্যান্য উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনভূমি এবং উচ্চভূমির বনাঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনভূমিতে উদ্ভিদ জীবনপ্রবাহের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। উদ্ভিদ জীবনচক্রের ভিন্নতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে উত্তর-পূর্বে বিশুদ্ধ পানি ও নি¤œ লবণাক্ততার প্রভাব এবং পানি নিষ্কাশন ও পলি সঞ্চয়ের ভিত্তিতে।
সুন্দরবনকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে একটি আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনভূমি হিসেবে, যা গড়ে উঠেছে সুগঠিত সৈকতে কেওড়া ও অন্যান্য সমুদ্র উপকূলবর্তী বৃক্ষপ্রধান বনাঞ্চলে। ঐতিহাসিকভাবে সুন্দরবনে প্রধান তিন প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে, যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা, স্বাদুপানি প্রবাহের মাত্রা ও ভূপ্রকৃতির মাত্রার সাথে সম্পর্কের গভীরতার ওপর ভিত্তি করে।
অঞ্চলজুড়ে সুন্দরী ও গেওয়ার প্রাধান্যের পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে ধুন্দল ও কেওড়া, ঘাস ও গুল্মের মধ্যে নলখাগড়া, গোলপাতা রয়েছে সুবিন্যস্তভাবে। কেওড়া নতুন তৈরি হওয়া পলিভূমিকে নির্দেশ করে এবং এই প্রজাতিটি বন্যপ্রাণীর জন্য জরুরি, বিশেষ করে চিত্রাহরিণের জন্য। বনভূমির পাশাপাশি সুন্দরবনের বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে নোনতা ও মিঠাপানির জলাধার, আন্তঃস্রোতীয় পলিভূমি, বালুচর, বালিয়াড়ি, বেলেমাটিতে উন্মুক্ত তৃণভূমি এবং গাছ ও গুল্মের এলাকা।
পরম্পরা বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দ্বারা কোনো একটি এলাকার অনুক্রমিক অধিগ্রহণ। কোনো একটা জমে উঠতে থাকা কাদা চরে আদি প্রজাতি ক্রমে বাইরে থেকে আসা নতুন প্রজাতি দ্বারা ধাপে ধাপে প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। সর্বশেষে ওই আবহাওয়ায় উপযুক্ত, এমন বিভিন্ন প্রজাতির গাছের এক স্থানীয় শ্রেণী তৈরি হয়। ট্রুপের মতে অনুক্রমিকতা সধারণত শুরু হয় নতুন পলি থেকে তৈরি হওয়া ভূমিতে। নতুন গড়ে ওঠা এই ভূমিতে প্রথম পত্তন হয় গেওয়ার এবং এর সাথে গোল পাতা। পলি জমতে জমতে ভূমি যখন উঁচু হতে থাকে, তখন সেখানে আসে অন্যান্য প্রজাতির গাছ। সবচেয়ে পরিচিত হলেও দেরিতে আসা প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি হলো গেওয়া। উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাঝে মাঝে স্রোতে ভেসে যাওয়া ভূমিটিতে এরপর আসা শুরু করে সুন্দরী।
সুন্দরবন বেশ কিছু প্রাণী প্রজাতি ও তাদের সাথে সম্পর্কিত অন্য প্রজাতিদের টিকিয়ে রেখেছে। এদের মধ্যে বাঘ ও শুশুককে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন উন্নয়নের। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে থাকা এ দু’টির অবস্থা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সামগ্রিক প্রাণীবৈচিত্র্য এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার শক্তিশালী সূচক। ২০০৪ সালের হিসাব মতে, সুন্দরবন ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, যা পৃথিবীতে বাঘের একক বৃহত্তম অংশ।
সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্যপ্রাণীর বিশাল আবাসস্থল। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা এবং এর লালনক্ষেত্রের ওপর মানুষের সম্পদ সংগ্রহ ও বন ব্যবস্থাপনার প্রভাব অনেক। কচ্ছপ, সুন্দি কাছিম, এবং ধুম তরুণাস্থি কাছিম, গিরগিটি, অজগর ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের স্থানীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচিত্র জীববৈচিত্র্যের আধার বাংলাদেশের সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতির আবাসস্থল। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির একটি বড় অংশ বিদ্যমান (যেমনÑ ৩০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭ শতাংশ পাখি ও ৩৭ শতাংশ স্তন্যপায়ী) এবং এদের একটি বড় অংশ দেশের অন্যান্য অংশে বিরল। সরকারের মতে, এই প্রাণিবৈচিত্র্যের মধ্যে দুই প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী বর্তমানে হুমকির মুখে। পাখি বিষয়ক পর্যবেক্ষণ, পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্রে পাখিবিজ্ঞানীদের জন্য সুন্দরবন এক স্বর্গ। ইতোমধ্যে বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, যার মধ্যে আছে বুনো মহিষ, পারা হরিণ, বুনো ষাঁড়, ছোট ও বড় একশৃঙ্গি গণ্ডার, বারশিঙ্গা, চিতাবাঘ। আরো লুপ্ত হয়েছে সাদা মানিক জোড়া কান টুনি, বোঁচা হাঁস, গগন বেড়, জলার তিতিরসহ বিভিন্ন পাখি।
ধারণা করা হয়, সুন্দরবনে শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। সাইডেনস্টিকার ও হাইয়ের (পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭৮) মতে, এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছ ১২০ প্রজাতির; অবশ্য বার্নাকসেকের মতে, (২০০০) বাণিজ্যিক মাছ ৮৪ প্রজাতির, কাঁকড়া-চিংড়ি ১২ প্রজাতির ও ৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে।
থাকা খাওয়া, যাতায়াত
থাকার জন্য সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট এবং বর্ষার রেস্টহাউজই ভরসা। টাইগার পয়েন্টে রুমপ্রতি ভাড়া ৫০০-১৭০০ টাকা। তবে ডরমিটরি টাইপের কিছু রুমে প্রতি বেডের ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। এখানে তিনটি আধুনিক সুবিধাসহ কনফারেন্স রুমও আছে। এ ছাড়া একসাথে ১০০ জন মানুষ এখানে থাকতে ও খেতে পারবে। এখানে আরো একটি স্পেশাল সুযোগ পাবেন। সেটা হলো, ছাদে বসে বার্ডস আই ভিউ থেকে সুন্দরবন দেখা। আর চাঁদনি রাত যদি পেয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই। আর যদি মংলা দিয়ে যেতে চান, তবে থাকার জন্য আছে পর্যটন করপোরেশনের মোটেল। ঢাকা থেকে বুকিং দিয়ে যেতে পারেন। ভাড়া ৮০০ থেকে ২২০০ টাকা।
ঢাকার কল্যাণপুর, মালিবাগ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সোহাগ, সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস, কে লাইন, এ কে ট্রাভেলস, এম আর, ঈগল, এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনসহ প্রায় ১২টি পরিবহনে সাতক্ষীরা যাওয়া যায়। এ কে ট্রাভেলস ও এম আর পরিবহনে সরাসরি যাওয়া যায় সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জে। ভাড়া ৫০০ টাকা। তবে এসি পরিবহনে যেতে পারবেন সাতক্ষীরা সদর পর্যন্ত। ভাড়া ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। সকাল, দুপুর ও রাতের তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে গাড়িগুলো ঢাকা ছেড়ে যায়। মংলা দিয়ে যেতে চাইলেও খুলনা বা মংলার বাস পাওয়া যাবে একই স্থান থেকে। সেখান থেকে ট্রলার বা বোটে যেতে পারেন সুন্দরবন। ঘাটে ট্রলার পাবেন অনেক। ভাড়া ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা।