আসুন, চড়ুইদের বন্ধু হই

এই ক্ষুদ্র পাখিটার প্রতি মানুষের ভালবাসা আর তেমন নেই। আর তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে পাখিটিকে এখন আগের মতো মাতিয়ে তুলতে দেখা যায় না। নাগরিক সভ্যতাই কী এই পাখিদের বিপদ! এক সময় ঘরের কোনে, উঠান, বারান্দায় এদের উপস্থিতি ছিল সরব। সারাক্ষণ কিচির মিচির করে বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। কিন্তু এই আধুনিক শহূরে এলাকায় এরকম বাড়ি কোথায়? যাও বা ঘরের ভেন্টিলেটারে বাসা বেঁধে থাকতো, এখন তাও থাকে না।
Read More News

 

আজ বিশ্ব চড়ুই দিবস। বিপন্ন চড়ুইদের রক্ষায় এবং যথাযথ পরিবেশ ফিরিয়ে দিতেই দিবসটির সূচনা। ২০১০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রথম চড়ুই দিবস পালন করতে দেখা যায়। চড়ুই পাখি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ও এদের বিলুপ্তি রুখতে যৌথ উদ্যোগ নেয় নেচার ফরএভার সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া ও ফ্রান্সের ইকো-সিস অ্যাকশন ফাউন্ডেশন, পাশাপাশি বিশ্বের বেশ কয়েকটি পরিবেশ সংস্থা। পরের বছরই ২০১১ সালের ২০ মার্চে গুজরাটের আহমেদাবাদে শুরু হয় Sparrow Award প্রদান। এ পর্যন্ত ৪০টির বেশি দেশ বিশ্ব চড়ুই দিবস পালনে এবং চড়ুই রক্ষায় এগিয়ে এসেছে।

 

চড়ুই চেনেনা বা দেখেনি এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। যে কোন লোকালয়ের আশেপাশে এই পাখিটি অতি সুপরিচিত। চড়ুই চঞ্চল প্রকৃতির পাখি। এরা জনবসতির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে তাই এদের ইংরেজি নাম হাউস স্প্যারো অর্থাৎ গৃহস্থালি চড়ুই। খড়কুটো, শুকনো ঘাস পাতা দিয়ে এরা মানুষের ঘরের আনাচে-কানাচে, কার্নিশে বাসা বাঁধে। সমস্ত দিন এরা লাফিয়ে বেড়িয়ে মাটি থেকে পোকামাকড় শস্য খুঁটে খায়। এটা ওদের স্বভাবজাত। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এদের কিচিরমিচির গান চারপাশকে জাগিয়ে তোলে। ভাবতে অবাক লাগে- গায়ক চড়ুই নাকি ৯০টি সুরে গান গাইতে পারে!

 

উইকিপিডিয়ার এক তথ্যমতে, পৃথিবীতে মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ুই দেখতে পাওয়া যায়। জীববিজ্ঞান অনুযায়ী এদের পরিবার ১১টি গণে বিভক্ত। হাউস স্প্যারো এদের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত। এদের আদি নিবাস ছিল মূলত ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ।

 

আমরা চারপাশে সচরাচর যে চড়ুইটি দেখি এটি ‘পাতি চড়ুই’। সাধারণত দৈর্ঘ্যে মাত্র ১৬ সেমি (৬.৩ ইঞ্চি)। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও স্ত্রী চড়ুইর দেহ মন্দা বাদামি ও ধূসরে মেশানো। পুরুষ পাখির দেহ উজ্জ্বল কালো, বাদামি ও ধূসর চিহ্নযুক্ত। এই চড়ুইয়ের আদি আবাস ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও এশিয়ায় হলেও বেশ কিছু অঞ্চলে প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় এ পাখিটির আগমণ এভাবেই। ফলে পৃথিবীতে পাতি চড়ুইই সবচেয়ে বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

 

মানববসতির আশেপাশে সহসাই এদের দেখা মেলে। শহরে বা গ্রামে, মানববসতির কাছাকাছি যেকোন পরিবেশে এরা নিজেদের স্বচ্ছন্দে মানিয়ে নিতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশে খাপখাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা থাকলেও সাধারণত জনহীন বনভূমি, তৃণভূমি ও মরুভূমিতে এরা বসবাস করে না। চড়ুইয়ের প্রাচুর্য ও মানব-সহচার্যের কারণে বিভিন্ন লেখালেখি ও অন্যান্য মাধ্যমেও এর উপস্থিতি প্রকট।

 

চড়ুই পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতিতে চড়ুইয়ের রয়েছে গুুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমাদের অসচেতনতার কারণে আমরা সেটা বুঝতে পারি না। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রকৃতি থেকে আর কোনো চড়ুইয়ের বিলুপ্তি নয়। আমাদের বাসাবাড়ির বারান্দায় যদি চড়ুইয়ের বাস উপযোগী করে দু’একটি ছোট বাক্স বেঁধে রাখি। এতে বিলুপ্তির হাত থেকে যেমন চড়ুই বাঁচবে, তেমনি বাড়ির শিশুরাও আনন্দ পাবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ছোটবেলা থেকে এরা একদিন হয়ে উঠবে প্রকৃতিপ্রেমী।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর জাহান সরকার এক নিবন্ধে চড়ুই আমাদের কতখানি উপকার করে তা উপলব্ধি করতে একটি বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করেন- ঘটনাটি চীনের।

 

চড়ুই ফসলের ক্ষেতের সর্বনাশ ডেকে আনে ভেবে ১৯৫৮ সালে মাও-সে-তুং এর নির্দেশে অসংখ্য চড়ুই নিধন করা হয়। কেননা একটি চড়ুই বছরে ৪ থেকে ৫ কেজি শস্য খায়। সুতরাং, দশ লক্ষ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ৬০ হাজার ব্যক্তির খাদ্যের জোগান দেওয়া যেতে পারে। অতএব শুরু হল প্রচারণা। রাতারাতি তৈরি হল ১ লাখ রঙিন পতাকা। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে উঠল গোটা দেশ। sparrow army কাজে লেগে গেল। পুরস্কার ঘোষণা করা হল চড়ুই মারার জন্য। বিভিন্ন পদ্ধতিতে চড়ুই নিধন হতে লাগল। যেমন- খুব জোরে জোরে ড্রাম বাজাতেই চড়ুই উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। ডিম নষ্ট করা হল। তছনছ করা হল বাসা। জাল দিয়ে ধরা হল অসংখ্য চড়ুই। বন্দুক দিয়ে মারা হল বাকি চড়ুই। এভাবে `The great sparrow campaign` নামে প্রচারণার মাধ্যমে চড়ুইশূন্য হল চীন। চীন থেকে চড়ুই হয়ে গেল বিলুপ্ত।
১৯৬১-৬২ সাল। চীনে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। মারা গেল প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ। ফসলের ক্ষেতে বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ এমনভাবে বেড়ে গেল যে ক্ষেত থেকে ফসল আর ঘরেই তোলা গেল না। দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর মিছিল। টনক নড়ল দেশটির সরকারের। নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিতে চড়ুই ফিরিয়ে দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হল চড়ুই আমদানি।
এক তথ্যে পাওয়া যায়, গত কয়েক দশকে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশক থেকে চড়ুইয়ের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮০ সাল নাগাদ পৃথিবীর বৃহদাংশজুড়ে হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। শুধু লন্ডন শহরেই ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে সংখ্যা হ্রাসের হার ৭০ ভাগ। যদিও ১৯২০ সাল থেকেই এ হ্রাসের আভাস পাওয়া যায় তবে ইদানীং মানবসৃষ্ট কর্মকান্ডের কারণে এদের হ্রাসের হার অত্যন্ত ঊর্ধ্বগতি।

 

চড়ুইয়ের সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ হল- নিয়ন্ত্রণহীন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষক যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করে। আর চড়ুই প্রধানত শস্যদানা, ঘাসের বিচির পাশাপাশি অসংখ্য পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বিশেষ করে পোকার শুককীট, মুককীট বা লেদাপোকা যারা শস্য উৎপাদনের অন্তরায়। চড়ুই এসব পোকার ক্ষতিকর আক্রমণ থেকে ফসল, সবজির ক্ষেত, বনাঞ্চল বাঁচিয়ে পরিবেশ ও অর্থনীতিতে গুুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর কারণে এসব খাবার খেয়ে তারা বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- গরুর ব্যথানাশক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক খেয়ে ৯৯ ভাগ শকুন আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

পাতি চড়ুই আমাদের গ্রাম-বাংলার ঘর-বাড়ি ও শহুরে ইমারতে অতি সহজেই দেখা যায়। পক্ষান্তরে, গেছো চড়ুই ততটা সহজে চোখে পড়েনা। গেছো চড়ুই অতি বিরল স্থায়ী পাখি। এবং কেবল সিলেট বিভাগের ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামে দেখা যায়। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে এ পাখি দেখা গেছে। কিন্তু সেই দেখা পাওয়াটাও কষ্টকর পাতি চড়ুই খুবই মানুষঘেঁষা হলেও এরা অনেকটা চালাক ও মানুষের কাছ থেকে একটু দূরে থাকতে চায়। কাছে গেলেই ঝোপালো গাছের ডালে চলে যায়। দলের একটি উড়াল দিলে বাকিগুলোও একে একে উড়ে যায়।

 

নতুনদের কাছে পাতি চড়ুই থেকে গেছো চড়ুইকে আলাদা করতে পারাটা বেশ কষ্টসাধ্য। দক্ষ পাখি পর্যবেক্ষক কাজটি অবশ্য সহজেই করতে পারেন। আলাদা করার সবচেয়ে সহজ উপায়টি হল এর মাথা ও মুকুটের দিকে লক্ষ্য করা। ছেলে ও মেয়ে পাখি উভয়ের রকম এবং মাথা, ঘাড় ও পুরো মুকুটের পালকের রঙ মরচে বাদামি বা চকলেট বাদামি।

 

পুুরুষ-স্ত্রী চড়ুই দেখতে আলাদা। পুুরুষের মাথা ধূসর ও নীল মেশানো, ঘাড় পিঠ ও পাখনা খয়েরি লাল বা পিঙ্গল। চোখের পেছন থেকে ঘাড় অবধি মোটা গাঢ় লালচে বাদামি বর্ণের। লেজ ও লেজের গোড়া ধূসর। স্ত্রী পাখির রঙ ওপরের দিকে ধূসর বাদামি, তার ওপরে কালচে বা পিঙ্গল দাগ, পেট সাদাটে। পুুরুষ পাখিটি দেখতে বেশি সুন্দর এবং সে বেশি গান গায়। মাঝে মধ্যে পুুরুষ বা স্ত্রী পাতি চড়ুইদের দুঃখভরা ভাব নিয়ে নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখা যায়।

 

শহরের ইমরাতগুলোতে ওদের সেই আরামদায়ক ফাঁকফোকর থাকছে না। বাড়িঅলারা নতুন নতুন নকশায় ইমারত নির্মাণ করছে। চড়ুই থাকলে ডিসটেম্পার নষ্ট হয়ে যাবে, তাই এই নতুন ব্যবস্থা। আবার ইদানিং জলাধারগুলো ভরাট করে চলে কল-কারখানা ও বাড়ী নির্মান। ফলে তেষ্টা মেটানোর জলটুকুও তারা পাচ্ছে না। ফসলের জমিও বিলিন হয়ে যাচ্ছে। পাচ্ছে না খাদ্য। আরও একটি বাধা হল মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলো। ওগুলো যেখান দিয়ে তরঙ্গ প্রবাহিত করে সেই জায়গাগুলোই চড়ুইদের ওড়ার জন্য বাধা।

 

এ রকম আরো নানা কারণে মানুষের চির প্রতিবেশি এই পাখিটি চলে যাচ্ছে দূরে। হয়ত কোনদিন হারিয়েও যাবে এরা। তবে আমরা চাইলেই এদেরকে আমাদের মাঝে রেখে দিতে পারি। এজন্য বেশি কিছু করার দরকার নেই। প্রতিদিন বেঁচে যাওয়া কিছু ভাত বারান্দায় রেখে দিই আর একটা বাসনে কিছু পানি রেখে দিই যেন গোসল আর তৃষ্ণাটুকু মেটাতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এ প্রাণীকুলকে আমাদের প্রয়োজনেই যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আসুন, চড়ুইদের বন্ধু হই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *