হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির নজিরবিহীন ঘটনায় কেউ যখন মুখ খুলছিলেন না, তখন গণমাধ্যমের কাছে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন দেশের মেধাবী সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রতারণার টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে তদন্তে যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন জোহা র্যাবের ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত থেকে বেশ কিছু তথ্য উদ্ঘাটন করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন—তাঁরা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরির কাজে যুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি ইউজার আইডি শনাক্ত করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ দেশের আরো বড় বড় সাইবার ক্রাইমের তদন্তের পাশাপাশি জঙ্গিদের সাইবার অপরাধ দমনেও সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সাইবার ক্রাইম-বিষয়ক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিলেন জোহা। কিন্তু বুধবার রাত থেকে তাঁর খোঁজ মিলছে না। তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে, অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকা থেকে জোহাকে অপহরণ করা হয়েছে। তাঁর সন্ধান পেতে স্বজনরা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কারো সহায়তা পাননি। এমনকি থানা পুলিশ অপহরণ বা নিখোঁজ হওয়ার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পর্যন্ত নিচ্ছে না। এ ঘটনার পর জোহার পরিবারে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তাঁকে ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তাঁরা। তবে র্যাব-পুলিশ বলছে, জোহাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
Read More News
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্তে দেশের স্বার্থে কাজ করা এই সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞের হঠাত্ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, এই ঘটনায় তানভির হাসান জোহার কোনো স্বার্থ ছিল না। তিনি সরকারকে সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু এভাবে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার কারণে সরকারি তদন্তকাজে ভবিষ্যতে বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা আর এগিয়ে আসতে চাইবেন না।
যেভাবে অপহরণ : গতকাল বৃহস্পতিবার কলাবাগানের নিজ বাড়িতে জোহার স্ত্রী ডা. কামরুন নাহার সাংবাদিকদের জানান, বুধবার রাত সোয়া ১১টায় কাজ শেষে কচুক্ষেত থেকে শেষবারের মতো ফোন দিয়েছিলেন জোহা। ফোনে বলেছিলেন, ‘বাড়ি ফিরছি।’ তবে সোয়া ১২টার পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। কামরুন নাহার আরও বলেন, বুধবার রাত ১২টার দিকে মিরপুর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে কাঁঠালবাগান যাচ্ছিলেন সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা ও তাঁর বন্ধু ইয়ামির আহম্মেদ। কচুক্ষেত এলাকায় আসার পর দুটি প্রাইভেট কার অটোরিকশার গতিরোধ করে। পরে দুজনকে সিএনজি থেকে নামিয়ে গাড়িতে ওঠায়। এ সময় দুজনের চোখ বেঁধে ফেলে দুর্বৃত্তরা। আর ইয়ামিরের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউর সামনে নিয়ে আসে। পরে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে জোহাকে নামানো হয়নি। তাঁকে কোথায় নিয়ে গেছে ওরা তাও বলতে পারেননি ইয়ামির।
কামরুন নাহার বলেন, ‘ইয়ামির বাসায় এসে অপহরণের বিষয়টি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কলাবাগান থানায় চলে যাই। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থল তাদের এলাকা না হওয়ায় জিডি নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। কাফরুল ও ভাসানটেক থানায় গেলেও একই কথা বলে পুলিশ।’
জিডি নেয়নি কোনো থানা : গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও জোহার চাচা মাহবুবুল আলম জিডি করতে আবার কাফরুল থানায় যান। কাফরুল থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তাঁদের জানায়, এটি ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় পড়েছে। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ঘটনাস্থল ভাসানটেক থানায় পড়েছে। পরে ওই থানায়ও যোগাযোগ করেন মাহবুবুল আলম। সেখান থেকেও বলা হয় ঘটনাস্থল তাদের এলাকায় পড়েনি।
কামরুন নাহার বলেন, ‘কোনো থানাই আমাদের জিডি নেয়নি। পুলিশের ভূমিকা কেন এ রকম, তা ভাবতে পারছি না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তো আমরা পুলিশের সহায়তা পেতে পারি। কিন্তু পুলিশ কোনো সহায়তাই করেনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে কামরুন নাহার বলেন, গত মঙ্গলবার জোহা অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। ওই দিন রাতে তিনি আমাকে জানান, অফিসে কাজ রয়েছে। রাতে বাসায় আসবেন না। সর্বশেষ বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় জোহার সঙ্গে কথা হয়। ওই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, একটু পর বাসার উদ্দেশে রওনা দেবেন। রাত সোয়া ১২টার দিকে তাঁর মোবাইল নম্বরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘জোহার বন্ধুর কথার সূত্র ধরে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম ব্যবহার করে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তো তিনি কোনো কথা বলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। এটা তো অন্যায় হতে পারে না। এর আগেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে জোহা জঙ্গি তত্পরতাসহ সাইবার অপরাধের বড় বড় ঘটনা তদন্তে সহায়তা করেছেন। তখন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এখন একটি মহলের স্বার্থে আঘাত লাগায় তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা চলছে বলে মনে হচ্ছে।’ স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
তানভির হাসান জোহার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনরাও দাবি করেছেন, বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির আসল ঘটনা প্রকাশ ও তদন্তের নামে বিদেশিদের হাতে তথ্য তুলে দেওয়ার ঝুঁকির কথা জানানোয় রোষানলে পড়েছেন তিনি।
মন্ত্রী-পুলিশকর্তা বলেন… : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে জোহাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে বিষয়টি আমি নিশ্চিত নই।’ মন্ত্রী আরও বলেন, আর যদি কেউ তাঁকে অপহরণ করে থাকে তাহলে তাঁকে উদ্ধার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বুধবার রাতে তানভির হাসান জোহার সঙ্গে ডিবি পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলমের কথা হয়েছে। তবে কী কথা হয়েছে, তা জানা যায়নি। জোহার নিখোঁজের ব্যাপারটি আমরা তদন্ত করছি। ডিবি পুলিশ তাঁকে আটক করেনি।’
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জোহাকে উদ্ধার করতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে তিনি অপহৃত হয়েছেন কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কেউ নন! : র্যাবের সঙ্গে মিলে রিজার্ভ চুরির তদন্তে তত্পর থাকলেও সোমবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘তানভির হাসান জোহা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন।’ মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি অনেক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরির ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন মন্তব্য করছেন তানভির হাসান জোহা নামে জনৈক ব্যক্তি। এতে বিস্মিত তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। কারণ ওই ব্যক্তি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কেউ নন।’ তবে তিনি আইসিটি বিভাগের সঙ্গে সাইবার ক্রাইমবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনসাইট বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন বলে গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন আবু নাসের।
সূত্র জানায়, তানভির হাসান জোহা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনসাইট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অপারেশন হিসেবে কাজ করতেন। এই সূত্রে তাঁর সংগঠনের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার ক্রাইমবিষয়ক কর্মসূচিতে তিনি ফোকাল পয়েন্ট ছিলেন। প্রকল্পটি নতুন অর্থ বরাদ্দের জন্য দুই মাস ধরে স্থগিত আছে। জানতে চাইলে ইনসাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক কাশিফ আলী খান গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বুধবার রাত ১০টার দিকে জোহা বলেছিল সে ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রাত ১২টার পর থেকে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ। ওকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার ক্রাইমে ওর মতো দক্ষ লোক আর নেই। দেশের পক্ষে কাজ করে তাঁর নিখোঁজ হওয়া উদ্বেগজনক এবং এতে এ ধরনের ঘটনায় পেশাজীবীরা সরকারি কাজে সহযোগিতা করতে ভয় পাবে, নিরুৎসাহিত হবে।’
তদন্তই কাল হলো : সূত্র জানায়, সাইবার নিরাপত্তার কাজের সুবাদে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আমন্ত্রণে জঙ্গি তত্পরতাসহ সাইবার অপরাধের বড় বড় ঘটনা তদন্তে সহায়তা করতেন জোহা। এ নিয়ে কোথাও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলে বিপদে পড়েন তিনি। গত রবিবার বিকেলে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল ও স্থানীয় আইটি এক্সপার্টদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে অর্থ চুরির ঘটনায় তদন্ত করা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট ভারতের নাগরিক রাকেশ আস্তানাও উপস্থিত ছিলেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলা এ বৈঠকে রাকেশ আস্তানা দাবি করেন, ঘটনাটি বাইরে থেকে ঘটানো হয়েছে। কিন্তু দেশীয় আইটি এক্সপার্টরা বলেন, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই। আর এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত সব প্রমাণও তাদের কাছে আছে। একপর্যায়ে রাকেশ আস্তানা দেশীয় আইটি বিশেষজ্ঞদের জানান, তাঁর তদন্ত শেষ হতে আরো সপ্তাহখানেক লাগবে। এরপর পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
বৈঠকে দেশীয় আইটি এক্সপার্টরা যে তিনটি আইডি শনাক্ত করেছেন সে বিষয়ে প্রযুক্তিগত প্রমাণ তুলে ধরেন রাকেশ আস্তানার কাছে। তাঁরা রাকেশ আস্তানাকে এও বলেন, সন্দেহভাজন পিসিতে ইউএসবি ডিভাইস ব্যবহার হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষায় এ জাতীয় তথ্য পাওয়া গেছে। দেশীয় প্রযুক্তিবিদরা তাঁকে আগে এ ডিভাইস ব্যবহারের কারণ অনুসন্ধান করতে বলেন। অর্থ চুরির ঘটনা ধামাচাপা দিতে এত দিন প্রভাবশালী যে চক্রটি নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছিল তারা দেশীয় সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞদের কাছে পিছু হটতে শুরু করে। দেশীয় অপরাধীরা অনেকটাই চিহ্নিত হতে শুরু করে। জোহা তাদের রোষানলে পড়তে পারেন বলে তাঁর এক সহকর্মী দাবি করেন। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ঘটনার পর জোহা বলেছিলেন, এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্তভার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে না দেওয়ার জন্য। এতে অনেক তথ্য হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশি এক্সপার্টরাই এটি উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। তিনি এর সপক্ষে তিনটি আইডি শনাক্ত করে এর তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। তিনি এই তদন্তের অনেক তথ্য জানতেন। কিন্তু তিনি সরকারের হয়ে দেশের পক্ষেই কাজ করছিলেন।’