বাংলাদেশের রাজকোষ কেলেঙ্কারি নিয়ে রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। একদিকে ফিলিপাইনের সিনেটের শুনানিতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অন্যদিকে অর্থের সন্ধান পাওয়া নিয়ে দুই সিনেটর সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই টাকা এরই মধ্যে ব্ল্যাকহোলে চলে গেছে। ওদিকে গতকাল ফিলিপাইনের সিনেট ব্লু রিবন কমিটিতে এ নিয়ে ২য় দফা শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ফিলরেম জানিয়েছে, চুরির অর্থ রূপান্তর করতে গিয়ে যে মুনাফা করেছে, তা বাংলাদেশকে ফেরত দেবে প্রতিষ্ঠানটি। আরসিবিসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, চুরি যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২০ মিলিয়ন পেসো ব্যাংকের ম্যানেজার মায়া সান্তোস দেগুইতোর গাড়িতে ওঠাতে দেখেছেন। ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো’র যে দুটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৮১ মিলিয়ন ডলার লোপাট করা হয়েছিল তা ছিল বানোয়াট। দেগুইতো এর আগে দাবি করেছিলেন মি. গোর অ্যাকাউন্ট ছিল আসল। এদিকে, দেগুইতোকে রাজসাক্ষী বানানো যেতে পারে কি না তা খতিয়ে দেখছে সিনেট।
প্রথম শুনানিতে আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখা ব্যবস্থাপক মারিয়া সান্তোস দেগুইতো ব্যাংকের গোপনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে কোনো প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিতে রাজি হননি। এদিনের শুনানিতে তিনি মুখ খুলবেন বলে গুঞ্জন ছিল। তবে এদিনও তিনি সকলের সামনে জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন তিনি একটি রূদ্ধদ্বার কক্ষে তার বক্তব্য দেন। সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন বলে বিবিসির খবরে বলা হয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে দেগুইতো কী বলেছিলেন তা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি। পরে শুনানি চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেগুইতো। সিনেট কমিটির চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে তিনি ক্লিনিকে চলে যান। ওদিকে, ফিলরেম নামের যে প্রতিষ্ঠান থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলারের বেশির ভাগ অর্থ পেসোতে রূপান্তর করা হয়েছিল, সে প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট সালুদ বাতিস্তা শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠান ওই লেনদেন থেকে যা মুনাফা করেছে তা সিনেটে উপস্থিত বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে ফেরত দেবেন বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন। ওই মুনাফার পরিমাণ ১০.৪৭ মিলিয়ন পেসো। শুনানির শেষ দিকে, তিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রশ্নবিদ্ধ উৎস থেকে আসা অর্থ তার প্রতিষ্ঠান রাখতে চায় না। আর যেহেতু এতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ, তাই তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কাছে এ অর্থ দিতে চান। এ সময় সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান তাকে বলেন, কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে না বলে, বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের দিকে তাকিয়ে বলুন। এরপর ২য় দিনের শুনানি মুলতবি ঘোষণা করে পরবর্তী শুনানির তারিখ ২৯শে মার্চ ঘোষণা করা হয়।
‘দেগুইতোর গাড়িতে টাকা ওঠাতে দেখেছি’: চুরি যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২০ মিলিয়ন পেসো ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের ম্যানেজার মায়া সান্তোস দেগুইতোর গাড়িতে তোলা হয়েছিল বলে শুনানিতে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। রোমুলডো আগারাদো নামের ওই কর্মকর্তা ব্যাংকের সাবেক কাস্টমার সার্ভিস প্রধান। সিনেট কমিটিতে তিনি বলেন, আমি নিজের চোখে দেগুইতোর গাড়িতে টাকা তুলতে দেখেছি। ঘটনাটি ঘটে ৫ই ফেব্রুয়ারি। কাগজের ব্যাগে পেচিয়ে ২০ মিলিয়ন পেসো গাড়িতে তোলা হয়। আগারাদো আরও বলেন, এর আগে ক্যাশ সেন্টারে সহকারী ব্যবস্থাপক অ্যাঞ্জেলা তোরেস এই টাকা তোলার কথা জানালে, গাড়িতে করে শাখায় টাকা আনা হয়। এরপর সেই টাকা গুনে একটি বক্সে করে প্রথমে রাখা হয় দেগুইতোর কক্ষে। পরে তা আবার কাগজের ব্যাগে ঢুকিয়ে সন্ধ্যার দিকে ম্যানেজারের গাড়িতে তুলে দেয়া হয়।’ এ সময় দেগুইতো প্রাণের ভয়ের কথা প্রকাশ করেছিলেন বলেও জানান আগারাদো। তিনি বলেন, উত্তোলন বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা চলে এলেও, দেগুইতো বলেছিলেন, আমি এটা (উত্তোলন) না করলে, আমি বা আমার পরিবার খুন হবে। তবে এ শুনানিতে উপস্থিত দেগুইতো ভয় পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বিষয়টি আরও বিস্তৃতভাবে বলতে রুদ্ধদ্বার শুনানির অনুরোধ করেন। এরপরই রুদ্ধদ্বার বৈঠক আয়োজন করেন সিনেটররা। সেখানে দেগুইতো কী বলেছেন, তা জানা যায়নি।
Read More News
‘গো’র অ্যাকাউন্ট বানোয়াট’: আরসিবিসি ব্যাংকের লিগ্যাল অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান ম্যাসেল এসতাভিলো গতকাল শুনানিতে বলেন, উইলিয়াম গো নামের এক ব্যবসায়ীর যে দুটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাট করা হয়েছিল সেই অ্যাকাউন্টগুলো ছিল বানোয়াট। এর আগে ম্যানেজার দেগুইতো দাবি করেছিলেন অ্যাকাউন্টগুলো নকল নয়, আসল। কিন্তু এসতাভিলো বলেন, তারা ব্যাংকের এক অভ্যন্তরীণ তদন্তে জানতে পেরেছেন যে, ওই দুটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি পেসো অ্যাকাউন্ট। অপরটি ডলার অ্যাকাউন্ট। পেসো অ্যাকাউন্টি খোলা হয় ২০১৪ সালে। আর ডলার অ্যাকাউন্টটি খোলা হয় ২০১৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। অ্যাকাউন্ট দুটোই জাল সই দিয়ে খেলা হয়। এসতাভিলো আরও জানান, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যে ঠিকানা দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ছিল ভুয়া। এসতাভিলো দাবি করেন, মি. গোর অজ্ঞাতসারে অ্যাকাউন্ট খেলার জন্য দেগুইতো তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, গোর অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে ব্যাংকের একটি নির্দেশ উপেক্ষা করেন দেগুইতো। পরে তিনি ২০ মিলিয়ন পেসো উত্তোলনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন গোর ডলার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেই অর্থ নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যান।
দেগুইতোকে রাজস্বাক্ষী বানানোর বিষয়টি খতিয়ে দেখবে সিনেট:
আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে রাজসাক্ষী বানানো যায় কি না তা খতিয়ে দেখবে ফিলিপাইনের সিনেট। প্রথম দিনের শুনানির মতো এদিনও দেগুইতো বলেন, তিনি সবার সামনে কিছু বলবেন না। শুধু রদ্ধদ্বার শুনানিতেই মুখ খুলবেন। এর আগে সিনেটর অ্যালান পিটার কায়েটানো বলেন, দেগুইতো যা জানেন সেটা যদি প্রকাশ না করেন তাহলে তাকে অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে। ক্যায়েটানো আর বলেন, দেগুইতোকে রাজসাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না সেটা এখনও খতিয়ে দেখার বিষয় আছে।
তদন্তের মুখে দেগুইতোর বস: আরসিবিসি ব্যাংকের আইনি প্রধান এসতাভিলো আরও জানিয়েছেন, দেগুইতোর বসকেও তদন্তের আওতায় আনা হবে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে তার সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত মিলেছে বলে তিনি জানান। গতকালের শুনানির মধ্যবর্তী বিরতিতে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তিনি। তবে তিনি এ-ও উল্লেখ করে এটা চলমান তদন্ত, ফলে বিস্তারিত কিছু তিনি প্রকাশ করতে অপারগ। দেগুইতোর ইমিডিয়েট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কে সেটা জানাতেও অস্বীকৃতি জানান তিনি। তবে আরসিবিসি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সিইও এর আড়ে দেগুইতোর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার বিস্তারিত জানান সিনেটরদের। এদের ম্যধ্যে ছিলেন একজন অঞ্চল প্রধান এবং ব্যাংকের পুরো রিটেইল শাখা ব্যাংকিক ইউনিটের প্রধান।
প্রশ্নবাণে জর্জরিত ফিলরেম: আরসিবিসি ব্যাংক থেকে উত্তোলিত অর্থ ফিলরেম নামের একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে পেসোতে রূপান্তর করা হয়। এদিনের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন ফিলরেমের প্রেসিডেন্ট সালুদ বাতিস্তা। শুনানিতে সিনেটরদের আক্রমাত্মক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন তিনি। শুনানির একপর্যায়ে বাতিস্তা দাবি করেন, অর্থের উৎস প্রশ্নবিদ্ধ থাকার বিষয়টি তারা জানতেন না। আর তারা প্রশ্নবিদ্ধ উৎস থেকে আসা অর্থ লেনদেনের মুনাফা রাখতে চান না। ওই মুনাফার অর্থ বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উৎসের পরিচয় যাচাইয়ে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ করেছেন অর্থ পাচারবিরোধী সংস্থা। সংস্থার প্রতিনিধি শুনানিতে বলেন, তারা একে ফিলরেমের সম্ভাব্য নীতিমালা লঙ্ঘন বলে মনে করছেন। তবে বাতিস্তা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ক্ষেত্রে তারা আরসিবিসি ব্যাংকের ওপর আস্থা রেখেছিল।
অর্থ পাচারে জড়িত ফিলিপাইনের ভাইস-প্রেসিডেন্টের আইনি প্রতিষ্ঠান: এদিকে ফিলিপাইনের দৈনিক এনকোয়ার দেশটির অর্থপাচার বিরোধী পরিষদের একটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, দেশটিরই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেজোমার বিনয়ের আইনি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের লোপাটকৃত অর্থ হংকং-এ পাঠাতে সাহায্য করেছে। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট বিনয় এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আসছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হওয়ায়, তার বিরোধীরা অর্থপাচার বিরোধী সংস্থাকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ব্যবহার করছে।
২০ কোটি পেসো ঘুষের প্রস্তাব, তদন্ত করছে ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের আটশ’ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা বাস্তবায়ন করতে ফিলিপাইনের ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের এক গ্রাহককে ২০ কোটি পেসো ঘুষ সেধেছিলেন ওই ব্যাংকেরই এক শাখা ব্যবস্থাপক। এতে করে এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে আরসিবিসি ব্যাংকের সঙ্গে এবারে জড়িয়ে পড়েছে ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের নামও। তবে ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংক বলছে, তাদের কাছে এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই এবং তারা বিষয়টি তদন্ত করছে। ফিলিপাইনের ডেইলি এনকয়ারারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন পর্যন্ত কেবল আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধেই ছিল অভিযোগ। এর সঙ্গে ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়েছে ওই ব্যাংকেরই গ্রাহক উইলিয়াম সো গো’র বক্তব্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে লোপাট হওয়া টাকা ফিলিপাইনে তারই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে এসব টাকা স্থানান্তরে তার নামে যে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তা ভুয়া বলে দাবি করেছেন তিনি। তার স্বাক্ষর জাল করে নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তার। সো গো বলছেন, তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ২০ কোটি পেসো উপার্জনের। ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক তাকে এই প্রস্তাব দেন। এর জন্য আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক মাইয়া সান্তোষ দেগুইতোর সঙ্গে চুক্তির কথা বলেন ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের ওই ব্যবস্থাপক। মঙ্গলবার ফিলিপাইন সিনেটের শুনানিতে এসব অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলেন উইলিয়াম সো গো। তিনি বলেন, তার কাছে ২০ কোটি পেসো উপার্জনের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন অ্যালান পেনালোসা। পেনালোসা ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের বোনিফেসিও গ্লোবাল সিটির একজন শাখা ব্যবস্থাপক। দেগুইতোর সঙ্গে উইলিয়ামের একটি বৈঠকেরও আয়োজন করেন পেনালোসা। সো গো বলেন, দেগুইতোর সঙ্গে তার সাক্ষাতের সময় তাকে এক কোটি পেসো দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। দেগুইতো অবশ্য শুনানিতে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। এ বিষয়ে বুধবার ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংক একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মাইয়া দেগুইতো ও উইলিয়াম সো গোর মধ্যে যে বৈঠক অ্যালান পেনালোসা আয়োজন করেছিলেন বলে বলা হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের জানা নেই। ব্যাংকের অফিসার হিসেবে তার যে দায়িত্ব তার সঙ্গে উইলিয়াম সো গোর সঙ্গে পেনালোসার জড়িত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও ব্যাংক বলেছে, এসব রিপোর্ট আমরা তদন্ত করবো। ব্যাংকের বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।
চুরি যাওয়া ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই: বাংলাদেশের চুরি যাওয়া ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই টাকা এরই মধ্যে ‘কালো গহ্বরে’ পতিত হয়েছে। কালো পথে চলে গেছে বিভিন্ন ক্যাসিনোতে। সেখান থেকে এ টাকা তুলে আনার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমন সতর্কতা দিয়েছেন ফিলিপাইনের দুই সিনেটর। এর মধ্যে রয়েছেন সিনেটর সার্জিও ওসমেনা তৃতীয়, সিনেট ব্লু রিবন কমিটির চেয়ার সিনেটর তিওফিস্তো গুইঙ্গোনা তৃতীয়। সিনেটর ওসমেনা বলেছেন, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, এ অর্থ এরই মধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এখন এ অর্থ উদ্ধারের বিষয়টি নির্ভর করে ক্যাসিনোগুলোর সহযোগিতার ওপর। উল্লেখ্য, রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখা থেকে ওই অর্থ উত্তোলনের পর তা চলে যায় ক্যাসিনোগুলোতে। সিনেটর তিওফিস্তো গুইঙ্গোনা বলেছেন, চুরি যাওয়া ওই অর্থ কালো গহ্বরে তার পথ করে নিয়েছে। সেখান থেকে এ অর্থ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন। সিনেটর ওসমেনা বলেন, আমরা ক্যাসিনোগুলোর কাছ থেকে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করবো। আমরা সোলাইয়ার’এর প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। কারণ, তিনি ছিলেন দেশের বাইরে। তিনি আরও বলেন, ক্যাসিনোগুলোর কাছে জানতে চেষ্টা করা হবে টাকাগুলো কোথায় গিয়েছে। এ বিষয়ে তাদের রেকর্ডও চাওয়া হবে। যাতে বোঝা যায় তারা কী পরিমাণ অর্থ পেয়েছে এবং তার মালিক কে। এছাড়া ক্যাসিনোগুলো থেকে টাকাগুলোর স্থানান্তর নিয়ে ‘ইলেকটোরাল ট্রায়াল’ খোঁজা হবে। সিনেটর ওসমেনা বলেন, আমি আশা করি ক্যাসিনোগুলো ইলেকট্রনিক ট্রায়াল সরবরাহ করবে। আমরা জানি না তারা কীভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে। এখানে আইনের রয়েছে অনেক ফাঁকফোকর। এসব ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যেতে পারে। ক্যাসিনোগুলো আইনের দোহাই দিয়ে কি কথা বলা থেকে বিরত থাকতে পারে- এমন এক প্রশ্নের জবাবে সিনেটর ওসমেনা বলেন, দেশের আইন সরকারের চেয়ে অপরাধীদের বেশি রক্ষা করে। এক্ষেত্রে তিনি গত মঙ্গলবারে সিনেট শুনানিতে আরসিবিসি কর্তকর্তাদের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। তারা আইনের দোহাই দিয়ে সব কথা সেদিন খুলে বলেননি।
এফবিআইয়ের সঙ্গে সিআইডির বৈঠক আজ: বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা চুরির মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই ও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনাটি আন্তঃদেশীয় সাইবার ক্রাইম হওয়ায় এফবিআই ও ইন্টারপোলের সরাসরি সহায়তা নেয়া হচ্ছে বলে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে। এরই মধ্যে সিআইডির কর্মকর্তা ইন্টারপোলের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেছে। এছাড়া আজ শুক্রবার এফবিআইয়ের বাংলাদেশ অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া গতকালও সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো পরিদর্শন করেছেন। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ এবং সিকিউরিটি সার্ভিল্যান্স শাখা পরিদর্শন করার পাশাপাশি কিছু ইকুইপমেন্ট জব্দও করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিং রুম সংশ্লিষ্ট লোকজনকে সন্দেহের শীর্ষে রেখে তদন্তকাজ চলছে।
সিআইডির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা তদন্তে এফবিআই ও ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতিমধ্যে ইন্টারপোলের সঙ্গে কথা হয়েছে। শুক্রবার এফবিআইয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে। তিনি বলেন, মামলাটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং জাতীয় স্বার্থ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় আমরা খুব সূক্ষ্মভাবে তদন্তকাজ করছি।
সিআইডি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার ছুটির দিন হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি শাখা খোলা ছিল। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পিও (প্লেস অব অকারেন্স) ভিজিটের অংশ হিসেবে গতকালও বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। গতকাল তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ও সিকিউরিটি সার্ভিলেন্স শাখা পরিদর্শন করেন। এসময় ওই শাখা থেকে সিআইডির ফরেনসিক ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা কয়েকটি কম্পিউটার ও অন্যান্য ইকুইপমেন্টও জব্দ করেন তারা। একই সঙ্গে এই দুই শাখায় কার কি দায়িত্ব তা জেনে নিয়ে প্রাথমিক সন্দেহভাজন হিসেবে একটি তালিকাও করা হয়। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় হ্যাকারদের দেশীয় এজেন্ট খুঁজে বের করা কঠিন চ্যালেনঞ্জ। হ্যাকার চক্র অনেক সূক্ষ্মভাবে এই কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না কেউ হ্যাকারদের সার্ভারে ঢোকার পথ তৈরি করে দিয়েছে। এজন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা জানার চেষ্টা করছে।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনাটি আন্তঃদেশীয় ক্রাইমের আওতায় পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সার্ভারে ঢুকে হ্যাকারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে পেমেন্ট অর্ডার এবং কোয়ারি ইনভয়েস পাঠিয়েছে। সেই টাকা যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় তিনটি ব্যাংকের মধ্যস্থতায় একটি অংশ ফিলিপাইন ও একটি অংশ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার অংশটি ফেরত আনা সম্ভব হলেও কার একাউন্টে তা যাচ্ছিল তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্সিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক ও কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যে জড়িত তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কার একাউন্টে ডলার ঢুকেছে তাও জানা গেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিদেশী নাগরিকদের ধরতে এফবিআই ও ইন্টারপোলের সাহায্য না নেয়ার কোনও বিকল্প নেই। ফিলিপাইন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির পুরো চক্রটিকে সনাক্ত করা সম্ভব। সেখান থেকেই হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে কারা কারা জড়িত তা বেড়িয়ে আসবে। সিআইডি সূত্র জানায়, একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়েও সমানভাবে অনুসন্ধান চলছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকালও মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে তদন্ত কার্যক্রম চালানোর গাইড লাইন তৈরি করেছেন। এতে কোন কোন বিষয়গুলি প্রথমে গুরুত্ব দেয়া হবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের সহায়তা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা থেকে অভিজ্ঞ যেসব কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে তদন্তের পৃথক পথে আগানোর জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে সঞ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির যাওয়ার ৪০ দিন পর গত মঙ্গলবার মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে একাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদি হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি করেন। দায়ের হওয়ার পরপরই মামলাটির তদন্তের ভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির কাছে স্থানান্তর করা হয়।
সময়ক্ষেপণ টাকা অনুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট: যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে লোপাট হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের খুব একটা আশা দেখছে না ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটি। ফিলিপিন্সের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই অর্থ পাচারের ঘটনার তদন্তে থাকা এই কমিটির চেয়ারম্যান তেওফিস্তো গুংগোনা বলেছেন, ওই অর্থ উদ্ধার করা খুবই কঠিন হবে, কেননা তা এরই মধ্যে ‘ব্ল্যাক হোলে’ ঢুকে পড়েছে। গত বুধবার সিনেট কমিটির শুনানিতে সিনেটর গুংগোনার এই বক্তব্য আসে বলে জানিয়েছে ফিলিপিন্সের ডেইলি ইনকোয়ারা। যদিও ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দাবি করে আসছে, খোয়া যাওয়া সব টাকা ফেরত আনা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ইতিমধ্যে আংশিক টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকাও ফেরত পাওয়া সম্ভব। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটির প্রধান ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, ২০ থেকে ৩০ দিন সময় লাগতে পারে। এখনও বলার মতো কিছু হয়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থউপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, চুরি হওয়া টাকা ফেরত পাওয়া সহজ হবে না। পেতে হলে সময় লাগবে। প্রথমে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হবে। আইনের আশ্রয় নিতে হবে। মামলা করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এসব কিছুর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঘটনার প্রায় ৪২ দিনেও বলার মতো কিছু হয়নি। সে ক্ষেত্রে ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির আশঙ্কা বা ধারণা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তিনি বলেন, সময়ক্ষেপণ বা বিলম্ব টাকা অনুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত দেখা যায় তড়িত গতিতে কাজ হয়। কিন্তু এখানের চিত্র ভিন্ন। কারণ, দেরিতে তদন্ত হলে অনেক সময় প্রমাণ বা আলামত মুছে ফেলা যায়। এতে আলামতের অভাবে তদন্ত বিঘ্নিত হয়। তবুও নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত প্রত্যাশা করেন তিনি।