বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়ার বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা বের করতে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। এ কমিশন নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে কারা দায়ী, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতা আছে কিনা বা তাদের কেউ জড়িত কিনা তা বের করবে। কমিশনের ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা গতকাল আমাদের সময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
Read More News
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আলাদাভাবে আলাপে তারা অভিন্ন কথা বলেন। অর্থনীতিবিদরা বলেন, এ ঘটনায় দেশের ইমেজের ক্ষতি হবে। তবে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। পরবর্তী সময়ে যাতে এ ধরনের ঘটনা না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। একই সঙ্গে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলেন তারা।
দেশের ইমেজ সংকট বাড়বে : মির্জ্জা আজিজ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির ঘটনাটি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে দেশের ইমেজের। এই চুরির কারণে বিদেশিদের কাছে একটি বার্তা যাবে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত যথেষ্ট নিরাপদ নয়। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারির কারণে বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে অনেকেরই নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। যতটা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ইমেজের ক্ষতি।
তিনি বলেন, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারকে ঘটনার গ্রহণযোগ্য একটি তদন্ত করতে হবে। প্রকৃত কারণ শনাক্ত করে জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে প্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে জড়িতরা যেই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ঘটনার মূল কারণ যতক্ষণ উদ্ধার করা না যাবে ততক্ষণ এ বিষয়ে তেমন কিছু বলা সম্ভব হবে না। তাই ঘটনাটির তদন্ত জোরদার করতে হবে।
এর আগে ক্রেডিট বা ডেভিট কার্ডের জালিয়াতির ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ওই ঘটনাগুলো ছিল অভ্যন্তরীণ বিষয়। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু রিজার্ভের ঘটনাটি শুরুই হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। এর সঙ্গে এখন ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে গেছে। ফলে ওইসব দেশেও এই ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রচার হচ্ছে। আর্থিক খাতের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে নিরাপত্তার দরকার ছিল, তা নেই। যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে। তাই এখনই এ খাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘটনা মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। যারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায় তারা এ ঘটনায় কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন থাকবে। তাছাড়া ম্যাক্রো ইকোনমির জন্য এ ঘটনা খুবই খারাপ নজির স্থাপন করবে।
নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে : সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়টির অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এরকম ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের বিকল্প নেই। তাছাড়া এসব খাতে যারা কাজ করে তাদের আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আপডেট ও আন্তর্জাতিক মানের রাখার পরামর্শ প্রদান করেন।
যথেষ্ট সতর্কতা না থাকায় এ ঘটনা ঘটেছে : ইব্রাহিম খালেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পৃথিবীর সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও রিজার্ভ থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুন বাইরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতোই। সম্ভবত ৩টি আলাদা কোড থাকে এবং আলাদা কম্পিউটার থেকে কাজ করা হয়। একটা গোপনীয়তা আছে। এখনো যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি সেই জন্য কী ঘটেছে সেটা এখনই বলা মুশকিল। এ বিষয়ে তদন্ত ছাড়া কিছু বলা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে আরও জানতে তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে হবে।
ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথেষ্ট সতর্কতা না থাকার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো তথ্য না দিলেও তারা যে বসে ছিল সেটা মনে হচ্ছে না। তারা শ্রীলংকাতেও লোক পাঠিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে ২ কোটি ডলার ফেরত পেয়েছে। আরও ৮ কোটি ডলার ফিলিপাইন থেকে গায়েব হয়েছে সেটা আনার ব্যাপারে কাজ চলছে। ৮৭ কোটি ডলার ফিলিপাইনে আটকে আছে। সেটা উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে পরিপূর্ণ একটি তদন্ত দরকার। এটি ছাড়া এর মূল কারণ বা কীভাবে হয়েছে তা বের করা সম্ভব হবে না। প্রকৃত ঘটনা জানা গেলেই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।
বাংলাদেশের জন্য অনাকাক্সিক্ষত : জায়েদ বখত
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। যদিও অন্য দেশে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভের লেনদেন সমন্বয় করার কথা। এ ঘটনার জন্য দেশীয় কোনো যোগসাজশ বা আন্তর্জাতিকভাবে কেউ দায়ী কিনা তাও তদন্ত করে বের করতে হবে। দোষীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় না আনলে এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে।
এমন ঘটনার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক অতিমাত্রায় লেনদেন করে তাই তাদের ক্ষেত্রে এসব দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লেনদেন করে কম। এছাড়া লেনদেন পদ্ধতি ও স্থান সবই অত্যন্ত সুরক্ষিত। ফলে এসব ঘটনা ঘটনার কোনো সুযোগ নেই। এই ঘটনা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া ঘটতে পারে না। এর পেছনে তথ্যপ্রযুক্তির ঘাটতি, কোনো মহল অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। তাই খুব তাড়াতাড়ি এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তদন্ত দরকার বলে জানান তিনি।
প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও নিরাপদ করার পরামর্শ প্রদান করে জায়েদ বখত বলেন, এই যুগে প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগতে হবে। তাছাড়া এখন লেনদেনের ক্ষেত্রে একজন যাচাই-বাছাই করে। এটা যেন দ্বিতীয় দফায় আবার যাচাই করা হয়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।