শিশুপুত্র হত্যার বর্ণনা দিলেন মা ছালমা

দুধ খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করায় বিরক্ত হয়ে সন্তানকে খুন করে মা ছালমা বেগম। তবে মানসিক অসুস্থতার জন্যই সে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। এজন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। শিশুপুত্র মাহাথিরকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে এমন জবানবন্দি দিয়েছে সন্তান হন্তারক মা ছালমা বেগম। গতকাল রোববার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে। বিকালে কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ শাহাদাত হোসেন তার খাস কামরায় ছালমা বেগমের এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিটি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে ছালমা বেগম শিশুপুত্রকে হত্যার অকপট স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এমন তথ্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই আলমগীর হোসেন জানান, শনিবার দুপুরে ছালমা বেগমকে ছেলে হত্যার অভিযোগে আটক করার পর পরই সে সন্তানকে হত্যার দায় স্বীকার করে নেয়। এরপরও মর্মান্তিক এ ঘটনার নেপথ্য কারণ জানার জন্য তাদের পক্ষ থেকে নিবিড়ভাবে মা ছালমা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার পেছনে সব সময়েই সে তার মানসিক অসুস্থতাকে কারণ হিসেবে জানিয়েছে। তদন্তেও ছালমা বেগমের মানসিক অসুস্থতার সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১৬/১৭ বছর আগে করিমগঞ্জের গুজাদিয়া ইউনিয়নের টামনি আকন্দপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল লতিফ মুন্সীর ছেলে মো. আবুল কালামের সঙ্গে সদরের মারিয়া ইউনিয়নের প্যারাভাঙ্গা গুচ্ছগ্রামের আসাদ মিয়ার মেয়ে ছালমা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের বছর দুয়েক পর স্থানীয় ধাত্রীদের হাতে প্রথম সন্তান সুরাইয়া আক্তারের জন্মদানের সময় প্রসব জটিলতা থেকে ছালমা বেগমের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রথম সন্তানের জন্মের অন্তত ৬ মাস পর পর্যন্ত ছালমা বেগম রাতে ঘুমাতে পারতো না। ফলে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ছাড়াও নিজ সন্তানকে সহ্য করতে পারতো না। এ ছাড়া সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রেও সে উদাসীন ছিল। ওই সময় ডাক্তারি ও কবিরাজি চিকিৎসা করিয়ে ছালমা বেগম কিছুটা সুস্থ হলেও প্রথম সন্তানের জন্মের বছর তিনেক পর দ্বিতীয় সন্তান কলি আক্তারকে জন্ম দিতে গিয়ে আবারও একই সমস্যা দেখা দেয় ছালমা বেগমের। তখনও একইভাবে নবজাতক সন্তানের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করে ছালমা। পরে বছর চারেক আগে তৃতীয় সন্তান তাইয়্যেবা আক্তার এবং সর্বশেষ মাস পনেরো আগে মাহাথির মোহাম্মদের জন্মদানের সময় একই জটিলতা দেখা দেয়। সংসার এবং সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বরাবরই ছালমা বেগম উদাসীন থাকায় সন্তানদের লালন-পালনের জন্য বাবা আবুল কালামকে শ্বশুরবাড়ির উপর নির্ভর করতে হতো। শ্বশুরবাড়িতে ছালমা বেগমের আরও ৬ বোন থাকলেও তারাও সংসারের অভাব-অনটনের কারণে সেভাবে ছালমার সন্তানদের দেখাশোনা করতে পারতো না। তবে সর্বশেষ সন্তান মাহাথি মোহাম্মদের জন্মের পর থেকে ছালমা বেগমের এই অসুস্থতা আরও বাড়ে। স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে স্বামী কালামকে বাড়ির একটি জমিও বিক্রি করতে হয়। এরপরও স্ত্রীর আরোগ্যের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং দিনকে দিন শিশুপুত্রকে নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ বাড়তেই থাকে ছালমা বেগমের। ছেলের কান্নাকাটি কিংবা কাছে আসা একদম সহ্য করতে পারতো না সে। এমনকি মাস দেড়েক আগে মাহাথিরকে মা ছালমা টামনি আকন্দপাড়ায় বাড়ির কাছের এক পুকুরে পানিতে ফেলে হত্যার চেষ্টা করে। এ সময় পরিবারের লোকজন দেখে ফেলায় সে যাত্রা প্রাণে রক্ষা পায় শিশু মাহাথির। কিন্তু দুগ্ধপোষ্য হওয়ায় মাকে ছাড়া মাহাথিরকে রাখতেও পারতেন না বাবা আবুল কালাম। এ অবস্থায় সন্তানদের স্বামীর বাড়িতে রেখে দিন দশেক আগে প্যারাভাঙ্গা গুচ্ছগ্রামের বাবার বাড়িতে ছালমা চলে আসে। ওই দিনই স্বামী আবুল কালাম শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে খালা ও শ্বশুর-শাশুড়িকে বলে মাহাথিরকে সেখানে রেখে আসেন। শনিবার সকালে বুকের দুধের জন্য শিশু মাহাথির মায়ের কাছে গিয়ে বারবার বায়না ধরায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছালমা। হাতের কাছে থাকা তরকারি কাটার দা দিয়ে মুরগি  জবাইয়ের মতো জবাই করে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে নিজ সন্তান মাহাথিরকে। পরে শিশুপুত্রের সেই নিথর দেহ ফেলে রাখে ঘরের দরজার চৌকাঠের সামনে। বাড়ির পাশের পুকুর থেকে রক্তাক্ত হাত-মুখ ধুয়ে এসে নিজেই চিৎকার করে সবাইকে বলে, ‘ছেলে আর কান্না করবে না’। শিশুপুত্রকে নৃশংসভাবে হত্যার এই ঘটনায় বাবা আবুল কালাম বাদী হয়ে শনিবার বিকালে নিহত মাহাথিরের মা ছালমা বেগমকে আসামি করে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা (নং-১০) করেন। মামলার এজাহারে আবুল কালাম লিখেছেন, আমার স্ত্রী ছালমা বেগম আমার মেয়ে তাইয়েবা (৪) এবং ছেলে মাহাথির মোহাম্মদ (১৫ মাস) কে নিয়ে গত ৮/১০ দিন আগে তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে যায়। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমি খবর পাই যে, আমার স্ত্রী আমার ছেলে মাহাথির মোহাম্মদকে খুন করেছে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক প্যারাভাঙ্গা গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দরজাসংলগ্ন বসতঘরের ভেতর আমার ছেলে মাহাথির মোহাম্মদের গলায় কাটা অবস্থায় লাশ পড়ে রয়েছে দেখতে পাই। এ সময় আশপাশের লোকজনের কাছে শুনতে পাই যে, আমার স্ত্রী মোছা. ছালমা বেগম তরকারি কাটা দা দিয়ে আনুমানিক সকাল পৌনে ১১টার সময় আমার ছেলে মাহাথির মোহাম্মদকে ঘটনাস্থলে জবাই করে খুন করেছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে এবং আমার স্ত্রী ছালমা বেগমকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। আমার ছেলের মৃত্যুতে আমি হতভম্ব। এজাহারে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন সন্তান হারানো বাবা আবুল কালাম। এদিকে শনিবার বিকালে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে শিশুটির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষে টামনি আকন্দপাড়া গ্রামে নিয়ে যাওয়ার পর স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। এশার নামাজের পর টামনি আকন্দপাড়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে শিশুটির লাশ দাফন করা হয়। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন জানান, শিশুপুত্রকে হত্যার দায় স্বীকার করে মা ছালমা বেগম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
Read More News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *