মার্চে বাঙালি একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত হয়

তত্কালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ সদ্যনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাত্ মুলতবি ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুন্দরবন থেকে তামাবিল— ৫৪ হাজার বর্গমাইলের সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গর্জে ওঠে। বঙ্গোপসাগরের ঊর্মিমালার মতো সমগ্র জাতি সংগ্রামের এক অনন্য ও অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা করে; যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গৌরবময় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতিসত্তা প্রথম আদায় করে নেয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এবার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাঙালিরা শাসন করবে পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি। গোপনে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে একজন সাধারণ শ্রমিক পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের এক সমাবেশে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন— ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। মেতে ওঠে ইতিহাসের এক নির্মমতম ও জঘন্যতম গণহত্যায়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে। সুতরাং মার্চ এলেই বাঙালি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাত্তরের মার্চ তাই কেবল সংগ্রাম-লড়াইয়ের সূচনালগ্নই নয়, চিরঞ্জীব এক প্রেরণার উত্স। বাঙালির দিনপঞ্জিতে মার্চ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেউ এ মাসকে অভিহিত করেন স্বাধীনতার মাস হিসেবে, আবার কেউ কেউ অগ্নিঝরা মার্চ হিসেবে। ’৭১ সালের এ মার্চ মাসেই শুরু হয়েছিল বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতাসূর্য অস্ত গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে পুনরায় উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা ও মূল্যবোধ। স্বাধীনতার গত ৪৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা অমাদের জাতির অগ্রগতির যেমন স্বাক্ষর পাই, তেমন কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতায় হতাশার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্থধারার বিকাশ না হওয়া উল্লেখযোগ্য বলেও মনে হয়। দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য, পশ্চাত্পদ চিন্তা থেকে একটি উন্নত-আলোকিত ও জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থধারাই দায়ী। আজকে ২০১৬ সালের মার্চে দাঁড়িয়ে আমাদের গৌরবময় অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করতে হবে। নিরক্ষতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে। ’৭১-এ আমাদের সাফল্যের মূল কারণ ছিল যে জাতীয় ঐক্য, সেই ধারায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক ধারায় রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া আজকের দিনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। অসুস্থ রাজনৈতিক ধারা, দুর্নীতি, অপসংস্কৃতিকে আমাদের অবশ্যই বিদায় জানাতে হবে। দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের এ পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগাবে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ’৭১ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা মুজিববাহিনীর প্রধান হিসেবে যে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, সেই রঙিন স্বপ্ন আমি এখনো দেখি। হয়তো আমরা যা পারিনি, নতুন প্রজন্ম সে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনো দিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ
Read More News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *