নিজের ওড়না পেঁচিয়ে দুই সন্তানকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেছেন মাহফুজা মালেক জেসমিন। মেয়ে অরণীকে সজাগ অবস্থায় আর ছেলে আলভিকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন তিনি। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। এ কারণেই তিনি তাদেরকে হত্যা করেন। তবে এর পেছনে আরো কোনো কারণ লুকিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা এখনো আড়াল করে রেখেছেন মাহফুজা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর বনশ্রীতে নুসরাত আমান অরণী (১২) এবং আলভি আমান (৭) নামে দুই ভাই-বোনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তাদের বাবা আমানউল্লাহ্ (৩৯) গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ব্যবসায়ী এবং মা বেগম মাহফুজা মালেক (৩৮) গৃহিণী। তারা গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে রামপুরার বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় বসবাস করে আসছিলেন। অরণী (১২) ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে এবং ছোট ভাই আলভি (৭) হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারিতে অধ্যয়নরত ছিল। দুই সন্তানের মৃত্যুর পর তার মা মাহফুজা প্রচার করেন খাদ্যে বিষক্রিয়ায় তার দুই সন্তান মারা গেছে।
র্যাব জানায়, প্রাথমিকভাবে মাহফুজা দাবি করেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের বিবাহবাষির্কী ছিল। এ উপলক্ষে পরিবারের সবাই ২৮ ফেব্রুয়ারি বনশ্রীর ক্যান্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে যান এবং খাওয়ার পর অবশিষ্ট খাবার সাথে করে নিয়ে বাসায় আসেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি অরণী এবং আলভি দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর আগের রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে আনা অবশিষ্ট খাবার খেয়ে ঘুমাতে যায়। ওই দিন বিকেলে তাদের মা ডাকাডাকির পর শিশু দু’টি ঘুম থেকে না ওঠায় স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মোবাইলে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে তিনি দাবি করেন, রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে বিষক্রিয়াজনিত কারণে তার সন্তানদের মৃত্যু হয়েছে।
শিশু দু’টিকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য আল রাজী হাসপাতাল, বনশ্রীতে নিয়ে যান নিহতদের বাবার বন্ধুরা। আল রাজী হাসপাতাল থেকে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হলে চিকিৎসক শিশু দু’টিকে মৃত ঘোষণা করেন। অপমৃত্যুর কারণে চিকিৎসক লাশ দু’টি পোস্টমর্টেম করার জন্য প্রেরণ করেন। ১ মার্চ লাশ নিয়ে বাবা-মা তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের উদ্দেশে রওনা হন। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী শিশু দু’টিকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি অভিযানিক দল ঘটনার সঠিক রহস্য উ˜্ঘাটনের জন্য ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশু দু’টির গৃহ শিক্ষিকা শিউলি আক্তার (২৮), খালু নজরুল ইসলামের ভাগ্নে শাহিন (২২), মেয়ের মার মামাতো ভাই মো: ওবায়দুর ইসলাম (৩৪), বাসার দারোয়ান পিন্টু মণ্ডল (৩২) ও ফেরদৌসকে (২৮) র্যাব কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাবাদের জন্য আনা হয় এবং জামালপুর জেলা থেকে মৃত শিশু দু’টির বাবা-মা ও খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
Read More News
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে জানা যায়, মৃত শিশু দু’টির মা মাহফুজা মালেক জেসমিন সর্বদা তার সন্তানদের স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাযুক্ত থাকতেন। মাহফুজার ধারণা ছিল, তার সন্তানেরা বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, মাহফুজা গত ২৯ ফেব্রুয়ারি মেয়ে অরণীর গৃহ শিক্ষিকা চলে যাওয়ার পর অরণী তার বাবা-মার বেড রুমে বিকেল আনুমানিক সোয়া ৫ টার দিকে ঘুমাতে যায়। তখন বাসায় দুই ভাই-বোন ছাড়া তাদের মা ও বৃদ্ধ দাদী ছিলেন। একই সময়ে আলভি আমান বেড রুমের বিছানাতেই ঘুমাচ্ছিল। মাহফুজাও ছেলের সাথে একই বিছানায় শুয়ে ছিলেন। অরণী তার মায়ের সাথে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোয়ার কিছু সময় পর মাহফুজা অরণীর গলা ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেন এবং একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে উভয়েই বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। কিছু সময় পর মেয়ের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে তিনি ছেলে আলভিকে খাটের ওপর ঘুমন্ত অবস্থায় একইভাবে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেন।
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি লাশ দু’টির সামনে কিছু সময় ধরে কান্নাকাটি করেন। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরপরই নিজেকে বাঁচানোর জন্য তিনি প্রথমে তার স্বামী আমানউল্লাহকে ফোন করে বলেন ছেলেমেয়ে কেমন জানি করছে এবং স্বামীর বাসায় ফিরতে দেরি হবে জেনে তার মা ও নিজ বোনকে ফোন করে বিষয়টি জানান। তিনি তাদের বলেন, দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমানোর পর তার সন্তানরা আর ঘুম থেকে উঠেনি এবং তিনি আগের রাতে আনা খাবারের বিষক্রিয়ার কারণে সন্তানদের মৃত্যু হয়েছে বলে সবাইকে জানান।
এ দিকে হাসপাতাল থেকে পালানোর বিষয়ে আলভির বাবা আমানউল্লাহ বলেছেন, সন্তানদের মৃত্যুর পর তিনি হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। তার ধারণা ছিল সন্তানদের ময়নাতদন্ত হয়তো স্ত্রী দেখতে পারবেন না। এ কারণেই স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘটনার পর তার স্ত্রীর ফোন পেয়েই তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন।
এ দিকে শুধুই সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে মাহফুজা যে কথা বলছেন তা মানতে পারছেন না অনেকে। তারা বলেছেন, এর পেছনে আরো কোনো কারণ আছে। সেখানে মাহফুজার পরকীয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে র্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান দাবি করেন, মাহফুজা মালেক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই বছর তিনি জামালপুর কলেজে শিকতা করেন। নিজে উচ্চশিতি হওয়ায় সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকতেন তিনি।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন তিনি। বড় সন্তানের জন্য তিনজন গৃহশিক রাখেন। মূলত এসব কারণেই দুই শিশু সন্তানকে হত্যা করেন তিনি। এদিকে স্বামী আমানউল্লাহ এই ঘটনায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।